জেলা 

হাওড়া বাগনানের চাকুর গ্রামের দেবী দুর্গা আরাধনার শতবর্ষের সংক্ষিপ্ত বিবরণ

শেয়ার করুন
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  

পবিত্র পাঁজা ও বাবু হক :  সালটা ১৯১৮ খ্রীষ্টাব্দ। তার আগে এই গ্রামে বিক্ষিপ্ত সময়ে তিনটি দুর্গা পুজো হয়েছিল তাঁদের কোনটাই শত বর্ষ অতিক্রম করতে পারেনি। অভয় চক্রবর্ত্তী, কৃষ্ণমোহন কোলে, রাধিকা দাস, অতুল বসুমল্লিক। এই চার মূর্তির কনিষ্ঠ ছিলেন অতুল বসুমল্লিক। অতুল ছোট বয়স থেকেই যাত্রায় অভিনয় থেকে পালাকার পরে প্রখ্যাত “আর্য অপেরা”-র  পরিচালক। এই সময়ের যাত্রাপালা গুলো হত পৌরানিক। বিশেষ করে মহিষাসুর মর্দিনী। তখন পাশাপাশি গ্রামের দুর্গা পুজো বলতে কল্যানপুর রায় পাড়ার এবং পুজো উপলক্ষ্যে পালাও হত। এই কারণে, মনে প্রানে অতুল চাইত-গ্রামে একটা দুর্গা পূজা হোক।
আমাদের গ্রামে অভয় চক্রবর্ত্তী সবচেয়ে রগড়ে সর্বজন ঠাকুর সম্বোধিত পুরোহিত ও পাঠশালার গুরুমশাই। কোন বিষয়েই-না নেই। অতুল বুঝল, এই অভয় ঠাকুরকেই মনের কথাটা খুলে বলা যাক। অভয় তা শুনে আনন্দিত হল। পরক্ষণে ভাবল ইংরেজ সরকার জমিদার ও গ্রামের অভিজাত পরিবার এই সব বাধা অতিক্রম করতে হবে! তখন দুর্গা পুজো ছিল মূলত জমিদার ও গ্রাম্য অভিজাত শ্রেণীর দখলে। সার্বজনীন শব্দটা বসানোই একটা বড় চ্যালেঞ্জ। গ্রামের অভিজাত পরিবার বলতে হরিশ্চ চন্দ্র খাঁ, ভুপতি পাঁজা, শ্যামাচরণ ও বামাচরণ মুখার্জী এবং অতুল পাঁজা। খাঁ বাড়ির কুল পুরোহিত ও অতুল পাঁজার প্রতিবেশী ছিলেন অভয় ঠাকুর। হরিশ্চ চন্দ্র খাঁকে বলতেই, বললেন”এই ভাবনাটা আমার মনে এলো না কেন”? মানে সবুজ সংকেত। ঘটনা চক্রে কৃষ্ণমোহন কোলে বাড়ির পুরোহিত ছিলেন অভয়। তাঁর কথা কি কৃষ্ণমোহন ফেলতে পারেন ! না।
এদিকে অভয় প্রতিবেশী ধণাঢ্য অতুল পাঁজাকে পুজোর কথাটা বললেন। অতুল পাঁজা সানন্দে গ্রহন করে, বললেন-বন্ধু রাধিকা দাসকে সঙ্গে নিয়ে আমরা উদ্যোগ নেব। আমরা তৎকালীন ঝিখিরার রাউতড়া রায় বাড়ি জমিদারীর অর্ন্তভূক্ত ছিল চাকুর সন্নিহিত এলাকা। অর্থাৎ প্রজারা দুর্গা পুজো করবে, জমিদারকে না জানিয়ে! সেটা হতে পারে না। জানাতেই হবে। কৃষ্ণমোহন কোলে ভূপতি পাঁজাকে জানালেন। ভূপতি বললেন-“এটা করলে গ্রামে অধিবাসীরা গ্রামেতেই পুজো দেখতে পারবে এর থেকে আনন্দের আর কি হতে পারে”।
রাধিকা দাসের সঙ্গে রাউতড়া রায় জমিদার বাড়ির নিবিড়তা ছিল। সেই কারনে-রাধিকা দাস, কৃষ্ণমোহন কোলে ও অভয় ঠাকুরকে সঙ্গে নিয়ে রাউতড়া গেলেন। গ্রামবাসীর আবদারের কথা জানাতেই জমিদার হরিদাস রায় বললেন-“মায়ের পুজা করবে; এতে বাধা দেব আমি। আমার বাড়ীতেও দুর্গা পূজা হয়। তা হলে সেই একই মা কে অপমান করা হবে। সেটা হওয়া উচিত নয়”। প্রথম বছরের প্রতিমার মূল্যটা যদি দেন আমদের গ্রামবাসী সবচেয়ে খুশী হবেন। পুজো দেখার আমন্ত্রন জানালেন। জমিদার রায় বললেন, প্রথম পাঁচ বছর মৃৎ প্রতিমার দাম আমি দেব। তবে পরে একদিন গিয়ে শ্যামাচরণ ও বামাচরণ মুখার্জীদেরও সঙ্গে দেখা করবো। (পরে বৃদ্ধ জমিদার হরিদাস রায়ের জেষ্ঠ পুত্র রোহিনী কুমার রায় বেশ কয়েক বার পুজো দেখতে আসতেন)।
খুব খুশি মনে বাড়ি ফিরল তিনজনে। পরের দিন সাত সকালে সুখবর দিতে অভয় ছুটলেন অতুলের বাড়ি।
অতুলকে জড়িয়ে ধরে,অভয়ের সে কি কান্না। যে লোকটাকে সদাই হাসতে দেখত; আজ সে কাঁদছে। অতুলেও দুচোখে আনন্দধারা।
তখন দুর্গা মন্ডপ ছিল না। এই খড়ের আটচালায় চাকুর গ্রামে প্রথম সার্বজনীন দুর্গোৎসবের শুভ সূচনা হয়েছিল ১৩২৫ বঙ্গাব্দে।
শুরু হল পুজোর ব্যবস্থাপনা। দেউলগ্রামের যোগীন্দ্রনাথ চন্দ্র প্রতিমা গড়লেন। মুখার্জীদের প্রতিষ্ঠিত পার্ব্বতী পুকুরে (তালপুকুর) নিমজ্জিত হল মঙ্গলঘট। বিরামপুর থেকে আগত ঢাঁকি-ঢুলির বাজনায় মুখরিত হল চারিদিক। রাত্রিকে দিনের আলোয় শোভিত করতে আনা হল বাইনান থেকে ডে-লাইট। সবেধন নীলমনি পুরোহিত অভয় চক্রবর্ত্তীর সুলালিত কন্ঠে উচ্চারিত হতে লাগল-“যা দেবী সর্বভূতে সু………”।

দ্রষ্টব্যঃ
ক) গ্রামের বর্তমান দুটি দুর্গা পূজার ব্যবস্থাপনায় “চাকুর সাধারণ কমিটি”।
খ) ইংরাজী ১৯৭৮ সালের বন্যার কারণে পূজা বন্ধ ছিল।
গ) ১৯৪৪খ্রীঃ ভূপতি পাঁজা পারিবারিক পূজার সূচনা করেণ। এই পূজাটি সার্বজনীন রূপ পায় ১৯৬২খ্রীঃ।
বর্তমানে গ্রামের দ্বিতীয় সার্বজনীন পূজাটি, চাকুর দক্ষিন পাড়ায় ধারাবাহিক ভাবে পরিবেশিত হয়ে চলেছে।
ঘ) বন্ধ দুর্গা পুজোঃ
১) ১৮৫০-৫৩খ্রীঃ প্রসাদবাটি পীরতলা সংলগ্ন দাস বংশের পুজার সূচনা।
২) ১৮৬২-৬৭খ্রীঃ শিবতলার গঙ্গরাম চক্রবর্ত্তী পিতা পারিবারিক পূজার সূচনা করেণ।
৩) ১৮৭০খ্রীঃ হরিবাসর সংলগ্ন মুখার্জী বংশের পূজার সূচনা। অনিয়মিত হওয়ার পর বন্ধ হয়ে যায়।
৪) ১৯৪৮খ্রীঃ সাংসদ ডাঃ পূর্ণেন্দু নারায়ন খাঁ ডাক্তারী পড়তে বিলেত গেলে, মঙ্গল কামনায় পিতা হরিশ্চচন্দ্র খাঁ পূজার সূচনা করেণ। এখন অনিয়মিত হয়।
৫) ১৯৫৪-৫৭খ্রীঃ এই চার বছর কালীতলায় অকাল বোধন পুজো হয়েছিল।

Advertisement

শেয়ার করুন
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  

সম্পর্কিত নিবন্ধ

Leave a Comment

9 + five =