অন্যান্য 

বামপন্থীদের রণকৌশল জাত ‘মুসলিম তোষণে‘র বক্তব্য কি সংখ্যগুরুদের মনে সংখ্যালঘুদের সম্পর্কে ভুল বার্তা বহন করে নিয়ে যাচ্ছে না ? পাশাপাশি বিজেপি – এর শক্তি বৃদ্ধির ক্ষেত্রেও কি সাহায্য করছে না ? : ড. আবদুস সাত্তার

শেয়ার করুন
  • 193
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  

আমাদের দেশ ভারতবর্ষ স্বাধীনতা লাভের পর ৭২ টি বছর পার করেছে। আজও দেশের সাধারণ মানুষ সেই অর্থে স্বাধীনতা পেয়েছে কী ? ৭২ বছর পর হিসাব মেলাতে গিয়ে প্রাপ্তির চেয়ে অপ্রাপ্তির সংখ্যাটাই বেশি করে চোখে পড়ছে। ৭২ বছর পরও এদেশের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে সামনের সারিতে আনার প্রতিশ্রুতি এখনও দেওয়া হয় দলিতসংখ্যালঘুরা এতদিন ধরে যে অর্জিত স্বাধীনতার সম্পদ ভোগ করে আসছিল তা আগামী দিনে থাকবে কিনা তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। দেশজুড়ে সংখ্যাগরিষ্ঠের জাতীয়তাবাদ এমন জায়গায় পৌছে গেছে যে আজ দেশের সব রাজনৈতিক দলই মন্দিরমুখী হয়ে পড়েছে স্বাধীনতার ৭২ বছর পর এদেশের দলিতসংখ্যালঘুদের নানা বিষয় নিয়ে বাংলার জনরব নিউজ পোর্টালের মুখোমুখি নব বালিগঞ্জ মহাবিদ্যালয়ের সিনিয়র অধ্যাপক এবং রাজ্যের সংখ্যালঘু উন্নয়ন মাদ্রাসা শিক্ষা দপ্তরের প্রাক্তন মন্ত্রী . আবদুস সাত্তার আজ অষ্টম কিস্তি।

প্রশ্ন : বামপন্থী দলগুলি বক্তব্য হলো , বর্তমান সরকারের ‘মুসলিম তোষণে‘র কারণে সংখ্যাগুরু সাম্প্রদায়িকতা পশ্চিমবঙ্গে বৃদ্ধি পাচ্ছে । বিষয়টি কি তাই ?

Advertisement

ড. আবদুস সাত্তার : এই প্রশ্নে এটাই এখন বামপন্থী দলগুলির  ঘোষিত রাজনৈতিক বক্তব্য অ শুধু বামপন্থীদের কেন , আরএসএস-বিজেপি তো একই কথা বলছে । বিজেপি তো ঠিক এই কথাটিই বার বার উচ্চারণ করে ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক-সামাজিক ক্ষেত্রে বিভাজন ঘটানোর এক নিরলস প্রয়াস বহুকাল ধরে করে আসছে ।স্বাধীনতা-পূর্ব ও স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে এই বিষয়ে তাদের প্রচেষ্টায় কোনো খামতি নেই । তাহলে তো বলতে হয় , অন্ততঃ এই প্রশ্নে বিজেপি আরএসএস-এর সঙ্গে বামপন্থী দলগুলির কোনো পার্থক্য নেই । ইমাম-মোয়াজ্জিন ভাতা, রমজান মাসে ইফতারে অংশ গ্রহণ ও রেড রোডস্থিত ঈদের নামাজের পর সকলের সঙ্গে দেখা করা , মুখ্যমন্ত্রীর এই ধরনের আচার-আচরণ ও বক্তব্যকে কি বামপন্থীরা  ‘তোষণ‘ বলে চিহ্নিত করতে চাইছেন ? অপরদিকে রাজ্য সরকারের প্রযোজনায় রেড-রোডে দূর্গাপুজোর শোভাযাত্রা , গঙ্গা-সাগর মেলা , তারাপীঠ থেকে তারকেশ্বর মন্দির উন্নয়ন কমিটি, পুজো কমিটিগুলিকে অর্থপ্রদান , রামনবমী ,জন্মাষ্ঠমী পালন – এই ধরনের ধর্মীয় বিষয় উদযাপনকে কি বলবেন ? ‘হিন্দু তোষণ‘? আবার , তৃণমূল কংগ্রেসের প্রভাবশালী  এক জেলা সভাপতি তো পুরোহিত সম্মেলন, গীতা বিতরণ সবই করে চলেছেন । তাহলে এইটাকেই বা কি বলবেন ? কী নামে চিহ্নিত করবেন ? শুধু তাই নয়,বর্তমান রাজ্য সরকার তো ‘খ্রিষ্টানদের ‘বড়দিন‘কে সাড়ম্বরে পালন করছেন । রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ‘বড়দিন‘-এ গীর্জায় উপস্থিত হয়ে প্রার্থনা করেন । এটাকেই বা কি বলবেন ? ‘খ্রিশ্চান তোষণ‘ ? এইগুলি কি শোনা যায় ? যন্ত্রনার হলেও সত্য যে , কোনো ক্ষেত্রে নয় , শুধু মাত্র মুসলমানদের বিষয়টিকেই ‘তোষণ“ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। যেহেতু এই অংশের মানুষ সহজ লক্ষ্যবস্তু । দেশভাগ জনিত অবিশ্বাস ধোঁয়াশা , ঘৃণা বিষয়টিকে ঘৃতাহুতি দিয়ে সব সময়েই সাহায্য করে চলেছে।
বিপদের বিষয় হলো, এই সমস্ত বিষয়গুলি জানা বোঝা সত্ত্বেও বামপন্থী দলগুলির , বিজেপি র সঙ্গে প্রায় সমস্ত বিষয়ে মতপার্থক্য থাকলেও বিজেপি প্রচারিত মুসলিম তোষণের তত্ত্বে সহজেই সায় দিয়ে চলেছে। এখন প্রশ্ন হলো–
এক, এই ভাবনা কি কোনো সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে ভবিষ্যতবাহী রাজনৈতিক ইঙ্গিত ?

দুই , তৃণমূল কংগ্রেসকে ক্ষমতা থেকে সরাতে না পারলে বিজেপির মতো সাম্প্রদায়িক শক্তিকে পরাস্ত করা যাবে না।সত্যি কি তাই? সমগ্র দেশ ও রাজ্যের বর্তমান বাস্তবতা কি বলে ? রাজ্যের গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরেপক্ষ, সংখ্যালঘু মানুষ কি বামপন্থীদের এই ভাবনার সঙ্গে সহমত পোষণ করছে ? আশু ও দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক রণকৌশলই বা কি? মনে রাখতে হবে, এটা একটা চক্রব্যুহ।এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে রাজনৈতিক সঠিক দিশাও খুঁজে পাওয়া যাবে না।উত্তরোত্তর সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ, যে কোনো বিষয়কে ধর্মের জিগির তুলে বিভাজনের পথে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।এইভাবেই আর এস এস বিজেপি রুজি রুটি কর্মসংস্থানের বিষয়টিকে বহুদূরে ঠেলে দিতে সমর্থ হয়েছে।তাই এখন মূল প্রশ্ন হচ্ছে, সাম্প্রদায়িক শক্তি, সাম্প্রদায়িকতাকে রাজ্যে এবং দেশে যে কোনো মূল্যে প্রতিহত, পরাস্ত করতে হবে।
তিন, বামপন্থীদের রণকৌশল জাত ‘মুসলিম তোষণে‘র বক্তব্য কি সংখ্যগুরুদের মনে সংখ্যালঘুদের সম্পর্কে ভুল বার্তা বহন করে নিয়ে যাচ্ছে না? পাশাপাশি বিজেপি এর শক্তিবৃদ্ধির ক্ষেত্রেও কি সাহায্য করছে না? সাম্প্রতিককালের লোকসভা, বিধানসভার উপনির্বাচনের ফলাফল কিসের ইঙ্গিত বহন করে চলেছে? ফলশ্রুতিতে ভয়ংকর ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে রাজ্যের সম্প্রীতির বাতাবরণ।

চার, পিছিয়ে পড়া, সংখ্যালঘু মানুষের উন্নয়ন রাজ্যে ধর্মনিরেপক্ষতা , সম্প্রীতি রক্ষার প্রশ্নে বামফ্রন্ট ও তৃণমূল কংগ্রেস পরিচালিত সরকারের ভূমিকা কি? আবার, এই অংশের মানুষের জন্য তৃণমূল কংগ্রেস যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতাসীন হয়েছিল তার কতটুকু পালন করেছে  – এই সমস্ত বিষয়ে জনমানসে আলোচনা- বিতর্কের একটা বড়ো সুযোগ বামপন্থী নেতৃবৃন্দের সামনে তো ছিল। যা ছিল সমাজের অন্যান্য অংশের থেকে সব থেকে পিছিয়ে পড়া মানুষের বাঁচার দাবি, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষ বাতাবরনকে আরো উর্ধ্বপানে তুলে ধরার দাবি অথচ তা হয়ে গেল বিজেপির মুসলিমদের সম্পর্কে উচ্চারিত নির্দিষ্ট রাজনৈতিক কথার প্রতিধ্বনি।অথচ পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার ভেতরে ও বাইরে এই নিয়ে জনমত গঠনের বিশাল সুযোগ ছিল ।বিধানসভায় বিরোধী দলগুলিও এই বিষয়ে কে , কি প্রশ্ন করেছেন?

পাঁচ , সাচার কমিটির প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর সিপিআই (এম)-র  পক্ষ থেকে সংখ্যালঘুদের উন্নয়নে যে  দাবি সনদ প্রধানমন্ত্রীর কাছে  পেশ করা হয়েছিল  তা ‘ মুসলিম তোষণ‘-এর  বক্তব্য কি তার সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ ?

ছয় , প্রসঙ্গত আমাদের মনে রাখতে হবে , সাচার কমিটির প্রতিবেদনে ‘মুসলিম তোষণ ‘-এর বিষয়টিকে সম্পূর্ণভাবে খারিজ করা হয়েছে ।

সাত , রাজ্যের মূলস্রোতের ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলির নেতৃবৃন্দ নিজেদের প্রশ্ন করবেন না , ভাববেন না – স্বাধীনতার ৭১ বছর পরেও রাজ্যের সংখ্যালঘু মুসলিম জনগোষ্ঠী রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক- সাংস্কৃতিক-শিক্ষা সর্বোপরি সরকারী চাকুরিতে আজো কেন বঞ্চনার  শিকার হয়ে চলেছে ? সব বিষয়ে ‘ঘাটতি‘-ই তো  মুসলিমদের  স্বাধীনোত্তর ফলকনামা ! তবু ‘তোষণে‘র তত্ত্ব মুসলিমদের পিছু ছাড়তে চায় না !

হায় ! ধর্মনিরপেক্ষ ভারত !

 

 


শেয়ার করুন
  • 193
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  

সম্পর্কিত নিবন্ধ

Leave a Comment

3 × 1 =