অন্যান্য কলকাতা 

রাজধর্ম, রাজ্হাঁস এবং রাজনীতি……

শেয়ার করুন
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  

সম্প্রতি ছাত্রনেতা আনিস খান থেকে শুরু করে তুহিনা খাতুন এবং কয়েক দিন আগে রামপুরহাটের বগটুইয়ের গণহত্যা নিয়ে রাজ্য জুড়ে শোলগোল পড়েছে । শুধু রাজ্য নয় দেশ তথা বিশ্বজুড়ে বগটুইয়ের লোমহর্ষক , মর্মান্তিক , নৃশংস নরসংহার সব মানুষের হৃদয়কে নাড়িয়ে দিয়েছে ! কিন্ত রাজনীতির কারবারীদের কাছে ‘সেই ট্রাডিশন সমানেই চলছে’। মানুষের মৃত্যু মিছিলের পথ ধরেই রাজনীতির পালাবদল ঘটে। রাজা আসে , রাজা যায়,সাধারণ মানুষের উপর অত্যাচার কমে না , গণহত্যার  ট্রাডিশন চলতেই থাকে……। এই পরম্পরাকে খানিকটা ব্যঙ্গ করে,হালকা চালে সাধারণ মানুষের বিবেকে চাবুক মেরেছেন বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কলামিষ্ট মুদাসসির নিয়াজ । তাঁর ফেসবুক ওয়াল থেকে এই লেখা নেওয়া হয়েছে।

ধু্ত তেরিকা। কানের গোড়ায় এমন প্যান প্যান করছে, যেন খুন আগুন লাশ —– এসব বাপের কালে শোনেনি! আরে মশাই হিংসা, প্রতিহিংসা, প্রতিশোধস্পৃহা — এসব ট্র্যাডিশন তো মান্ধাতা আমল থেকেই চলে আসছে। এ আর এমন নতুন কী? এগুলোকে আর পাঁচটা স্বাভাবিক ঘটনা বা মামুলি বলে মেনে নিতে পারলেই তো সব ল্যাটা চুকে যায়। সামান্য পান থেকে চুন খসলেই যদি এত উথাল পাতাল হয়, তাহলে বাঁচবি কদিন? এতখানি নাট ঢিলে হলে আজকের দিনে চলবে না। শক্ত হতে হবে। মানুষ শক্তের ভক্ত।

জোর যার মুলুক তার। ক্ষমতায় থাকলে সাত খুন মাফ। একরত্তি বয়স থেকেই এসব প্রবাদ শুনে শুনে তো আমাদের কান পচে গেছে। সবার ওপরে রাজনীতি সত্য, তাহার উপরে নাই। এ তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না। গেরস্থালির চৌকাঠ থেকে চমকাইতলা সবখানেই তো রাজনীতির অবারিত দ্বার। তাই তো হরিদ্বার। যেখান থেকে ধর্ম সংসদ বসিয়ে মুসলিমদের গণহত্যার ডাক দেওয়া হল!!

Advertisement

তুই হিন্দু। আমি মুসলিম। আমরা যে যার ধর্ম নিজের মতো করে মেনে চলার চেষ্টা করি। আর নেতামন্ত্রীদের ধর্ম হল রাজধর্ম। তবে হাঁসের রাজা যেমন রাজহাঁস, রাজধর্ম কিন্তু ধর্মের রাজা নয়। রাজধর্ম হলো রাজার ধর্ম। সেটা পালন করেন ওনারা। এ কি চাট্টিখানি কথা। মেনে চলা আর পালন করা তো এক জিনিষ হতে পারে না। দুইয়ের মধ্যে আসমান জমিন ফারাক।

রামপুরহাট এর বগটুই গ্রামে এতবড় একটা লোমহর্ষক ঘটনা ঘটে গেল, আর আমরা ছেবলামো করার জায়গা খুঁজে পেলাম না। ছি ! না এবার একটু সিরিয়াস কথা হোক। আসলে নীতির রাজা রাজনীতি না হয়ে, রাজার নীতি রাজনীতি হলে যা হয় আর কী? তাই তো শাসক বদলায়, শাসন বদলায় না। ক্ষমতার পালাবদল মানে নতুন বোতলে পুরনো মদ ছাড়া কিছুই নয়। কী কেন্দ্রে, কী রাজ্যে। গল্প সেই একই।

ঘটনা, দুর্ঘটনা কিছুই না ঘটলে পুলিশ-আদালত কিছুই তো থাকবে না। অর্থাৎ অন্তত পুলিশ-আদালতকে টিকিয়ে রাখতে হলে হিংসা, সন্ত্রাসকে মেনে নিতে হবে। আর জনৈক মন্ত্রী বাহাদুর যখন একথা বলছেন, জো হুজুর। না মেনে উপায় নেই। মন্ত্রীর কথা অমান্য করব, এতবড় লাটের বাঁট এখনও হইনি।

হাড়হিম করা এহেন নূশংস ঘটনা যখন ঘটে — মানুষ বিস্মিত হয়, হতবাক হয়, শিহরিত হয়, স্তম্ভিত হয় আরও কত কিছু হয়। তবে সবাই নয়। কেউ কেউ পুলকিতও হয় বৈকি। লাশ পোড়া গন্ধ যারা পছন্দ করে। তারাই তো শোলোক কাটে, ঘ্রা অর্ধ ভোজনং। এরা শকুনির জাত। এদের অভিশাপেই তো দিকে দিকে লাশ পড়ে।

খুন খারাবি এদের কাছে পৌষমাস। অবশ্য কারও কারও কাছে সর্বনাশ। যারা পথের কাঁটা মনে করে জনৈক ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গকে পূথিবী থেকে চিরতরে সরিয়ে দিল, তাদের তো কেল্লা ফতে। সুতরাং তারা কেন মরতে দুঃখ পাবে। তারা কেন শোকে পাথর হবে। তাদের তো এটাই এনজয় করার মোক্ষম সুযোগ। কতদিন থেকে তারা কত প্ল্যানিং করেছিল। শিকার করতে ওৎ পেতে বসেছিল। কাকে কাকে সব টাকা দিয়ে হাত করেছিল। কাকে কাকে সব টাকা দিয়ে মুখ বন্ধ করতে নিদান দিয়েছিল। কাকে কাকে সব চোখ রাঙিয়ে হুমকি দিয়ে বলেছিল, মুখ খুললে তোদের বংশে বাতি দেবার কেউ থাকবে না।

সূচপুর, নানুর, খেজুরি, পিছাবনী, নেতাই, শীতলকুচি, সারদা, বগটুই ইত্যাদি গ্রাম যে আমাদের এই রূপসী বাংলায় আছে, কেউ কি তা জানত? নাকি কস্মিনকালেও জানতে পারত? এরকম গ্রাম ভারতে কয়েক লক্ষ আছে। কিন্তু এসব অখ্যাত গ্রামগুলোর নাম দেশের প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত জেনে গেলেন, এ কী কম কথা। তাছাড়া এসব না ঘটলে আমরা যারা সিকি আধুলি সাংবাদিক বা লেখালিখি করি, তারা তো কলম চালাচালির সুযোগই পেতাম না।

সত্যি কথা স্বীকার করতে আমার অন্তত গায়ে ফোসকা পড়ে না। সাংবাদিকরা কী সাংঘাতিক। সবাই গেল একই জায়গায়। সবাই দেখল, শুনল, জানল একই ঘটনা। কিন্তু সবাই লিখল আলাদা আলাদা। পরদিন কাগজের খবর দেখে চক্ষু চড়কগাছ। কেউ লিখল দুষ্কূতি, কেউ লিখল অমুক দলের আশ্রিত বা মদদপুষ্ট দুষ্কূতি, কেউবা লিখল অজ্ঞাত পরিচয় আততায়ী। সবকিছু দেখার, শোনার, জানার পরেও কেউ লিখল, এমনটাই অভিযোগ উঠেছে। কেউ লিখল অভিযোগের তীর অমুক দলের দিকে।

রাজনৈতিক দলগুলোও তাদের খোরাক পেয়ে গেল। লাশ নিয়ে রাজনীতি করতে হবে। এটাই তো তাদের নেশা, নাকি পেশা কী যেন বলে। তাদের কাছে সবথেকে ভাবনার বিষয়টা হল, ভোট বড় বালাই। তাই এমনভাবে খেলতে হবে, যাতে সাপও না মরে, লাঠিও না ভাঙে। যাকে বলে সেফ ড্রাইভ, সেভ লাইফ। আপনার আমার সঙ্গে ওনাদের মেলাতে পারবেন না। কারণ ওনাদের ধর্ম হলো রাজধর্ম। আমরা ধর্ম মানি, আর ওনার ধর্ম পালন করেন। এই হল নেতা আর জনতার মধ্যে তফাৎ।

এতগুলো মানুষ মারা গিয়েছে। তাই প্রথমেই বেশ গুছিয়ে পরিপাটি করে শোক ও সমবেদনা জানাতে হবে। নিহতদের পরিবারবর্গকে সান্ত্বনা দিতে হবে। তাই সব দলের নেতারাই হটস্পটে যান, এটাই নিয়ম। ঘোলা জলে মাছ ধরতে হবে সবাইকেই। কিছুদিন পর অবশ্য সেই জল থিতিয়ে যাবে। যেমন মাস খানেক আগে ঘটা আনিস খুনের জল এখন থিতিয়ে গেছে।

এবার রামপুরহাটের বগটুই গ্রামে ফিরে আসি। কেউ কেউ এই হত্যাকাণ্ডের ধরনকে গুজরাট গণহত্যার সঙ্গেও তুলনা করেছেন। আমি কিন্তু একেবারে চিলেকোঠায় না উঠে সদর দরজায় দাড়িয়েই বলি। কোনও না কোনও দলের হার্মাদরাই তো দরজা বন্ধ করে এতগুলো মানুষকে প্রথমে পিটিয়ে আধমরা করেছে, তারপর খুন করেছে বা বাড়ি বাড়ি ঘুরে অগ্নিসংযোগ ঘটিয়ে নির্বিচারে শিশু, মহিলা সহ সবাইকে আগুনে পুড়িয়ে ঝলসে হত্যা করেছে। সেই নারকীয় ভিডিয়ো দেখে মনে হচ্ছিল যেন খিদিরপুরের হোটেলের শিক কাবাব। মানুষগুলোকে পুড়িয়ে একেবারে কাঠকয়লা বানিয়ে তবেই তারা তূপ্ত হয়েছে। একই গ্রামের প্রতিবেশিরা এতখানি পাষাণ হূদয়হীন দজ্জাল জল্লাদ হতে পারল কার অনুপ্রেরণায়, এ প্রশ্ন তোলা কি সমিচীন নয়?

১৯ ফেব্রুয়ারি হাওড়ার আমতার সারদা গ্রামে প্রতিবাদী কণ্ঠ আনিস খানের রহস্যময় হত্যাকাণ্ডের পর ফেসবুকে একটা লিখেছিলাম। তারই অংশবিশেষ এখানে তুলে দিলাম………

কেউ প্রতিবাদে গর্জে উঠবে, কেউ মুখে কুলুপ আঁটবে। কিছুদিন মিডিয়ার বিট বাইটের খেলা হবে। স্টেরয়েড মেশানো নেতারা দিন কয়েক আনাগোনা করবেন। নাতিশীতোষ্ণ ভাষণ দেবেন।কেউ দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির জোরালো দাবি জানাতে সুর সপ্তমে চড়াবেন। কেউবা ইনসাফ চেয়ে ১৬৫ ডেসিবেলে সাওয়াল করবেন।

তারপর কালের অমোঘ নিয়মে খেজুর গাছ একদিন তেল হয়ে যাবে। ঝাঁকের কই সব ঝাঁকে ফিরে যাবে। চ্যাপ্টার ক্লোজড। রিজওয়ান, মইদুল, সুদীপ্ত, আনিসদের কাতার দীর্ঘতর হবে। আবার কেউ বা কারা রক্ত নদীর ভেলায় চড়ে পৃথিবীকে আলবিদা জানিয়ে ইউরেনাস কিংবা নেপচুনে পাড়ি জমাবে। আনিস ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো ১৯ ফেব্রুয়ারি আসছে বছর আবার আসবে, ক্যালেন্ডার বদলে যাবে।

নিহত আনিসের আব্বা মায়ের দু চোখের কার্নিশে জমে থাকা ফরিয়াদ একদিন পাথর হয়ে যাবে। আমাদের আটপৌরে জীবন দিনগত পাপক্ষয় ফর্মুলায় চলছে, চলবে। প্রতিবাদীরা জীবন দিয়ে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি করেই যাবে। তুমি সবুজ, আমি গৈরিক, কেউবা লাল রঙের চশমা পরে আছি। তাই আমরা ওরা কখনো এক হতে পারবো না। ব্রিটিশের Devide & Rule পলিসিতে মহামান্য জনদরদী নেতারা আমাদেরকে ভাগ করে রেখেছেন।

এই বিভাজন আসলে ভোটব্যাঙ্ক ও পার্টি গণিতের খেলা।আমাদের করণীয় কিছু নেই। সুতরাং নিজেকে সান্তনা দিয়ে বলি, এত বড় দেশ, দু একটা খুন হলে কি মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে ? এই মৃত্যু উপত্যকাতেও বিন্দাস থাকার পাসওয়ার্ড হল মোদিজি চৌকিদার আর দুয়ারে সরকার। আর কি চাই ? ধর্মেও আছি, জিরাফেও আছি। এই বেশ ভালো আছি।

রামপুরহাটের নৃশংস হত্যাকাণ্ডেও সেই লেখার এই অংশটুকু কপি পেস্ট করলাম। এটুকু অপরাধ ক্ষমাসুন্দর দূষ্টিতে দেখার এবং মার্জনা করার অনুরোধ রইল।

 

@…..M Niaz……২৫.০৩.২০২৩


শেয়ার করুন
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  

সম্পর্কিত নিবন্ধ