বিনোদন, সংস্কৃতি ও সাহিত্য 

অমুসলিম গবেষকদের চোখে মানবতার দিশারী হযরত মুহাম্মদ (সা.)

শেয়ার করুন
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  

বিশেষ প্রতিনিধি : হযরত মুহাম্মদ(সা.) বিশ্বের বিস্ময়কর ব্যক্তিত্ব । তিনি পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম ব্যক্তি যিনি একাধারে একটি ধর্মের প্রচারক অন্যদিকে শাসক বা সম্রাট। ধর্মের প্রচারক হিসাবে কোথাও তিনি নীতি-আদর্শ থেকে দূরে সরে যাননি। সম্রাট বা শাসক হিসাবে ‘রাজধর্ম’ পালন করে গেছেন। তিনি সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠা করেছেন , নারীর অধিকার নিশ্চিত করেছেন , ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শ তিনি নিখুঁতভাবে বাস্তবায়ন করেছেন। তিনি একমাত্র মহাপুরুষ যিনি সমগ্র মানব জাতিকে এক আদমের সন্তান বলে অভিহিত করেছেন । বিশ্বজনীন ভ্রাতৃত্বেবোধ তৈরি করেছেন।অথচ আজকাল একদল কূপমন্ডুক ইসলামবিদ্বেষী মানবতার মুক্তিদূত নবি মুহাম্মদ (সা.) সম্পর্কে কটূমন্তব্য করতে দ্বিধা করছে না। এখানে মুহাম্মদ (সা.) সম্পর্কে বিভিন্ন অমুসলিম মনীষীদের কিছু উদ্ধৃতি তুলে ধরা হলো। এই সব অমুসলিমরা বিশ্বজুড়ে খ্যাতি পেয়েছেন তাঁদের চোখে হয়রত মুহাম্মদ কেমন তা নিচে দেওয়া হলো :

১. জর্জ বার্নার্ড শ :

Advertisement

‘মুহাম্মদের ধর্মের প্রতি আমি সবসময় সুউচ্চ ধারণা পোষণ করি, কারণ এর চমৎকার প্রাণবন্ততা। আমার কাছে মনে হয় এটাই একমাত্র ধর্ম যেটা সদা পরিবর্তনশীল জীবনযাত্রার সাথে অঙ্গীভূত হওয়ার ক্ষমতা রাখে, যা প্রত্যেক যুগেই মানুষের হৃদয়ে আবেদন রাখতে সক্ষম। আমি তাঁর (মুহাম্মদ) সম্বন্ধে পড়াশোনা করেছি। চমৎকার একজন মানুষ তিনি এবং আমার মতে খ্রিস্টবিরোধী হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে অবশ্যই মানবতার ত্রাণকর্তা বলতে হবে। আমি বিশ্বাস করি তাঁর মতো ব্যক্তির নিকট যদি আধুনিক বিশ্বের একনায়কতন্ত্র অর্পণ করা হতো তবে এর সমস্যাগুলো তিনি এমনভাবে সফলতার সাথে সমাধান করতেন যা বহু প্রতীক্ষিত শান্তি ও সুখ আনয়ন করতো। আমি ভবিষ্যদ্বাণী করছি যে, মুহাম্মদের ধর্মবিশ্বাস আগামীদিনের ইউরোপের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে, যা ইতোমধ্যে বর্তমান ইউরোপে গ্রহণযোগ্যতা পেতে আরম্ভ করেছে।’ [দ্যা জেনুইন ইসলাম, খন্ড : ১, পৃষ্ঠা : ৮]

২. টমাস কার্লাইল :

‘এই লোকটিকে (মুহাম্মদ সা.) ঘিরে যে মিথ্যাগুলো (পশ্চিমা অপবাদ) পুঞ্জীভূত হয়ে আছে—যার ভালো অর্থ হতে পারে ধর্মান্ধতা, তা আমাদের নিজেদের জন্যই লজ্জাজনক।’ [হিরোস অ্যান্ড হিরো ওয়ারশীপ, ১৮৪০]

৩. উইলিয়াম ড্রাপার :

‘জাস্টিনিয়ানের মৃত্যুর চার বছর পর, ৫৬৯ খৃস্টাব্দে আরবে একজন মানুষ জন্মগ্রহণ করেন, যিনি সকলের চাইতে মানবজাতির ওপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। অনেক সাম্রাজ্যের ধর্মীয় প্রধান হওয়া, মানবজাতির এক-তৃতীয়াংশের প্রাত্যহিক জীবনের পথনির্দেশক হিসেবে কাজ করা—এসবকিছুই সৃষ্টিকর্তার দূত হিসেবে তাঁর উপাধির যথার্থতা প্রমাণ করে।’ [হিস্টোরি অব ইন্টেলেকচুয়াল ডেভলপমেন্ট অব ইউরোপ]

৪. আলফোন্স ডি লামার্টিন :

‘উদ্দেশ্যের মহত্ত্ব, লক্ষ্য অর্জনের উপায়সমূহের ক্ষুদ্রতা এবং আশ্চর্যজনক ফলাফল যদি অসাধারণ মানুষের তিনটি বৈশিষ্ট্য হয় তবে কে মুহাম্মদের সাথে ইতিহাসের অন্য কোন মহামানবের তুলনা করতে সাহস করবে? বেশির ভাগ বিখ্যাত ব্যক্তি শুধুমাত্র সেনাবাহিনী, আইন এবং সাম্রাজ্য তৈরি করেছেন। তাঁরা যদি কিছু প্রতিষ্ঠা করে থাকেন সেটা কিছুতেই জাগতিক ক্ষমতার চাইতে বেশি কিছু নয়, যা প্রায়ই তাদের চোখের সামনে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। এই মানুষটি শুধুমাত্র সেনাবাহিনী, আইন, সাম্রাজ্য, শাসক, লোকবলই পরিচালনা করেননি সেইসাথে তৎকালীন বিশ্বের লক্ষ-লক্ষ মানুষের জীবনকে আন্দোলিত করেছিলেন; সবচেয়ে বড় কথা হলো তিনি দেব-দেবী, ধর্মসমূহ, ধারণাগুলো, বিশ্বাসসমূহ এবং আত্মাগুলোকে আন্দোলিত করেছিলেন।

দার্শনিক, বাগ্মী, বার্তাবাহক, আইনপ্রণেতা, নতুন ধারণার উদ্ভাবনকারী/ধারণাকে বাস্তবে রূপদানকারী, বাস্তব বিশ্বাসের পুনরুদ্ধারকারী…বিশটি জাগতিক এবং একটি আধ্যাত্মিক সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা—এই হলো মুহাম্মদ। মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব পরিমাপের যত মাপকাঠি আছে তার ভিত্তিতে বিবেচনা করলে আমরা নিজেদেরকে প্রশ্ন করতে পারি—মুহাম্মদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ কেউ আছে কি?’ [হিস্টোয়ার ডি লা টার্কি, প্যারিস : ১৮৫৪]

৫. মাইকেল এইচ. হার্ট :

‘মুহাম্মদকে সর্বকালের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের তালিকায় শীর্ষস্থান দেয়াটা অনেক পাঠককে আশ্চর্যান্বিত করতে পারে এবং অন্যদের মনে প্রশ্নের উদ্রেক হতে পারে, কিন্তু ইতিহাসে তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি রাজনীতি এবং ধর্মীয় উভয় পর্যায়ে সর্বোচ্চ পরিমাণ সফল ছিলেন। সম্ভবত ইসলামের ওপর মুহাম্মদের তুলনামূলক প্রভাব খ্রিস্টান ধর্মের ওপর যিশু ও সেন্ট পলের সম্মিলিত প্রভাবের চেয়ে বেশি। …আমি মনে করি, ধর্ম ও রাজনীতি উভয়ক্ষেত্রে প্রভাবের এই বিরল সমন্বয় যোগ্য ব্যক্তি হিসেবেই মুহাম্মদকে মানবেতিহাসের সবচেয়ে প্রভাবশালী একক ব্যক্তিত্ব হিসেবে আবির্ভূত করেছে।’ [দ্যা হান্ড্রেড, নিউ ইয়র্ক : ১৯৭৮]

৬. উইলিয়াম মন্টগোমেরি ওয়াট :

‘নিজ আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য সকল প্রকার কষ্ট সহ্য করা, তাঁকে যারা বিশ্বাস করতো এবং নেতা হিসেবে অনুসরণ করতো তাদের সুউচ্চ চারিত্রিক গুণাবলি এবং মুহাম্মদের অর্জনের বিশালত্ব—এ সবকিছুই তাঁর সততার সাক্ষ্য দেয়। আর কোন ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বই মুহাম্মদের মতো পাশ্চাত্যে এতবেশি অবমূল্যায়িত হয়নি শুধুমাত্র যা বর্ণিত হয়েছে তার ভিত্তিতে নয়, আমরা যদি মুহাম্মদকে সামান্য পরিমাণও বুঝতে চাই তবে অবশ্যই প্রয়োজনীয় সততা ও ন্যায়পরায়ণতা সহকারে তাঁকে বিচার করতে হবে। আমরা যদি আমাদের অতীত থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত ভুলগুলো সংশোধন করতে চাই তবে এটা ভুলে গেলে চলবে না যে, চূড়ান্ত প্রমাণ আপাতদৃষ্টিতে যা সত্য বলে প্রতীয়মান হয় তারচেয়ে অনেক কঠিন শর্ত এবং এই ব্যাপারে প্রমাণ অর্জন সত্যিই দুঃসাধ্য হবে।’ [মুহাম্মাদ অ্যাট মাক্কা, অক্সফোর্ড : ১৯৫৩]

৭. ডি. জি হোগার্থ :

‘গুরুত্বপূর্ণ অথবা তুচ্ছ, তাঁর দৈনন্দিন প্রতিটি আচার-আচরণ একটি অনুশাসনের সৃষ্টি করেছে যা লক্ষ-কোটি মানুষ বর্তমানকালেও সচেতনতার সাথে মেনে চলে। মানবজাতির কোন অংশ কর্তৃক আদর্শ বলে বিবেচিত আর কোন মানুষকেই মুহাম্মদের মতো এতো পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে অনুসরণ করা হয়নি। খৃস্টধর্মের প্রতিষ্ঠাতার আচার-আচরণ তাঁর অনুসারীদের জীবন-যাপনকে নিয়ন্ত্রণ করেনি। অধিকন্তু, কোন ধর্মের প্রতিষ্ঠাতাই মুসলমানদের নবির মতো এরকম অনুপম বৈশিষ্ট্য রেখে যায়নি।

৮. অ্যাডওয়ার্ড গিবন :

‘মুহাম্মদের মহত্তের ধারণা আড়ম্বড়পূর্ণ রাজকীয়তার ধারণাকে অস্বীকার করেছে। স্রষ্টার বার্তাবাহক পারিবারিক গৃহকর্মে নিবেদিত ছিলেন। তিনি আগুন জ্বালাতেন, ঘর ঝাড়ু দিতেন, ভেড়ার দুধ দোয়াতেন এবং নিজ হাতে নিজের জুতা ও পোশাক সেলাই করতেন। পাপের প্রায়শ্চিত্তের ধারণা ও বৈরাগ্যবাদকে তিনি অস্বীকার করেছেন। তাঁকে কখনও অযথা দম্ভ প্রকাশ করতে দেখা যায়নি, একজন আরবের সাধারণ খাদ্যই ছিলো তাঁর আহার্য।’ [রোমান সাম্রাজ্যের উত্থান-পতন, ইংল্যান্ড : ১৭৭৬]

৯. স্ট্যানলে লেন-পুল :

‘তিনি যাদেরকে আশ্রয় দিতেন তাদের জন্য ছিলেন সবচেয়ে বিশ্বস্ত রক্ষাকারী, কথাবার্তায় ছিলেন অত্যন্ত মিষ্টভাষী ও নম্র। তাঁকে যারা দেখত তারা শ্রদ্ধায় পূর্ণ হতো; যারাই তাঁর কাছে এসেছিল তাঁকে ভালোবেসেছিল; যারা তাঁর সম্বন্ধে বর্ণনা দিত তারা বলতো, তাঁর মতো মানুষ আগে বা পরে আমি কখনো দেখিনি। তিনি ছিলেন অতি স্বল্পভাষী, কিন্তু যখন তিনি কথা বলতেন জোরের সাথে এবং সুচিন্তিতভাবে কথা বলতেন। তিনি যা বলতেন তা কেউ ভুলতে পারতো না।’ [স্পীচস অ্যান্ড টেবিলটক অব দ্যা প্রফেট মুহাম্মাদ, লন্ডন : ১৮৮২]

১০. জুলস মাসেরম্যান :

নেতাদের অবশ্যই তিন ধরনের কাজ সম্পাদন করতে হয়—অনুসারীদের মঙ্গলের ব্যবস্থা করা, এমন একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠানের সৃষ্টি করা যেটাতে সাধারণ লোকজন তুলনামূলকভাবে নিরাপত্তা বোধ করে এবং অনুসারীদের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ বিশ্বাসের জোগান দেয়া। প্রথমটি বিবেচনায় নেতা হলেন লুই পাস্তুর এবং সাল্ক। দ্বিতীয় এবং তৃতীয় বৈশিষ্ট্য বিবেচনায় একদিকে গান্ধী ও কনফুসিয়াস এবং অন্য দিকে আলেকজান্ডার, সিজার ও হিটলার—এরা হলেন নেতা। যিশুখ্রিস্ট ও গৌতম বুদ্ধ তৃতীয়টি বিবেচনায় নেতা। আর মুহাম্মদ হলেন সর্বকালের শ্রেষ্ঠ নেতা, যিনি উপরোক্ত তিনটি কার্যই সম্পাদন করেছেন। স্বল্প পরিসরে হলেও মুসাও একই কাজ করেছিলেন। [টাইম ম্যাগাজিন, জুলাই : ১৯৭৪]  সৌজন্যে: দৈনিক অধিকার।


শেয়ার করুন
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  

সম্পর্কিত নিবন্ধ