স্বাধীনতা সংগ্রামী আলিমুদ্দিনকে ‘অপমান’ করার অধিকার কোনো সংবাদ মাধ্যমের নেই , সিপিএম আর আলিমুদ্দিন আকাশ পাতাল তফাৎ !
সেখ ইবাদুল ইসলাম : কয়েক দিন আগে বেশ কযেকটি বহুল প্রচারিত দৈনিক সংবাদপত্র , নিউজ পোর্টাল এবং টিভি চ্যানেলগুলি ফলাও করে প্রচার করে আলিমুদ্দিনে এই প্রথম বার পালিত হবে স্বাধীনতা দিবস এবং জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হবে । আলিমুদ্দিন কে ? সংবাদ মাধ্যমের সাংবাদিকরা জানেন কী । এদেশকে স্বাধীন করার জন্য যেসব মানুষ রক্ত দিয়েছিলেন , আত্মত্যাগ করেছিলেন । সেই সকল মহৎ মানুষদের একজন হলেন আলিমুদ্দিন সাহেব । যিনি নিজে একজন ধর্মপ্রাণ মানুষ হয়েও দেশের স্বাধীনতার জন্য আত্মত্যাগ করেছিলেন ।
সশস্ত্র সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছিলেন । বিপ্লবী দলকে অর্থ সাহায্য করার জন্য গড়ে তুলেছিলেন স্বদেশী ডাকাত দল । দেশের জন্য , দেশের স্বাধীনতার জন্য যে মানুষটি এতটা আত্মত্যাগ করেছেন তাঁর নাম করে কটাক্ষ করতে লজ্জা করে না । স্বাধীন দেশের নাগরিক হয়ে সংবাদ পত্রে খবর লিখতে গিয়ে একবারের জন্য ওই মানুষটির শ্রদ্ধাবোধ জাগ্রত হলো না । কটাক্ষ করে লেখা হল আলিমুদ্দিনে উঠবে প্রথম জাতীয় পতাকা । লজ্জা করে না ! ওই মানুষটি ইচ্ছা করলে আরাম-আয়াসে জীবন-যাপন করতে পারতেন, শুধুমাত্র দেশকে স্বাধীন করার স্বপ্ন নিয়ে ব্রিটিশের চোখে ধুলো দিয়ে দিনের পর দিন আত্মগোপন করেছেন । সেই ইতিহাস কেন লেখা হবে না তথা কথিত বহুল প্রচারিত সংবাদ মাধ্যমগুলিতে । যারা নিজেদেরকে বাঙালি সংস্কৃতির ধারক-বাহক বলে মনে করে থাকে । তাঁরা কেন একজন বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে অবদানের কথা কৃতজ্ঞতা চিত্তে স্মরণ করবেন না ?
তা না করে এই মহৎ স্বাধীনতা সংগ্রামীর নামকে ব্যবহার একটি রাজনৈতিক দলকে কটাক্ষ করা হচ্ছে। এটা তো স্বাধীনতার অপমান । স্বাধীনতার সংগ্রামীর অপমান । বাঙালির অপমান । আসলে এই সাংবাদিকদের পড়াশোনা তেমন একটা নেই । আলিমুদ্দিন যে সিপিএম ছিলেন না , তিনি যে একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন । স্বাধীনতা সংগ্রামে তাঁর অবদানের কথা স্বীকার করেই একটি রাস্তার নাম তাঁর নামে করা হয়েছে । এই সহজ কথাটা বুঝে উঠতেই পারেননি তথা কথিত হোয়াইট কালার সাংবাদিকরা । আনন্দবাজারের মতো একটি সংবাদপত্রও ফলাও করে আলিমুদ্দিনে উঠবে প্রথম জাতীয় পতাকা বলে হেডিং করেছে । আলিমুদ্দিন তো একটি রাস্তার নাম !
এই রাস্তায় উপরে প্রতি বছরে অনেক জাতীয় পতাকা ওঠে । সিপিএমের সদর দফতরে এই প্রথম জাতীয় পতাকা তোলা হবে । এটাই খবর হওয়া উচিত ছিল । আলিমুদ্দিন একজন দেশপ্রেমিক, স্বাধীনতা সংগ্রামী, দেশকে স্বাধীন করার জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন । এই মহান মানুষটির সঙ্গে সিপিএমের তুলনা করবেন না । কারণ সিপিএমকে দেশপ্রেমের পরীক্ষা দিতে হতে পারে ! তবে আলিমুদ্দিনকে নয় । আর কোনো দিন একথা শোনা না যায় আলিমুদ্দিনে এটা হচ্ছে , দয়া করে বলবেন সিপিএম পার্টি অফিসে এটা হচ্ছে । সিপিএম এবং আলিমুদ্দিন আকাশ পাতাল তফাৎ ।
আলিমুদ্দিনের সংক্ষিপ্ত পরিচয় :
১৮৮৪ সালের এক বর্ষণমুখর দিনে ঢাকার জমাদার লেনে জন্ম নেন স্বাধীনতা যুগের এক অগ্নিপুরুষ, সৈয়দ আলিমদ্দিন আহম্মদ। বাবা আমিরুদ্দিনের ছিল সামান্য এক দর্জির দোকান। অল্প বয়সেই আলিমদ্দিনের বাবা মারা যান। গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য আলিমদ্দিনকে টিউশন পড়ানোর কাজ শুরু করতে হয় ।
জীবনের এই সমস্ত ভাঙাগড়ার খেলাকে পাথেয় করেই পরবর্তীতে স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দিলেন যুবক আলিমদ্দিন। ঘটনাচক্রে হেমচন্দ্র ঘোষ ছিলেন এই আলিমদ্দিনের বন্ধু। এই হেমচন্দ্রই স্বাধীনতার বীজমন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন আলিমদ্দিনকে।
সাল ১৯০৫। ইতিহাসের পাতা বলছে সময়টা উত্তাল। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন তখন পুরোদমে শুরু হয়ে গেছে। ইংরেজ সরকারের দমননীতির গ্রাফ প্রতিদিনই ঊর্ধ্বমুখী। এমন সময় বিপ্লবী হেমচন্দ্র প্রতিষ্ঠা করলেন এক গুপ্তসমিতি। যার অন্যতম সভ্য ছিলেন এই আলিমদ্দিন ওরফে মাস্টারসাহেব। তাঁর নেতৃত্বে যুবকদের শারীরিক কসরতের জন্য বেশ প্রতিষ্ঠিত হল বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান। বস্তুতপক্ষে এই প্রতিষ্ঠানগুলির মাধ্যমেই চলত বিভিন্ন বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ড এমনকি স্বদেশি ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ করার প্রাথমিক পাঠও দেওয়া হত এই প্রতিষ্ঠানগুলির মাধ্যমেই। না এখানেই থেমে থাকেননি মাস্টারসাহেব। একের পর এক বিপ্লবীকে প্রয়োজনীয় শেল্টার দিয়েছেন। সাহায্য করেছেন অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে। বিপ্লবের কাজে প্রয়োজনীয় অর্থসাহায্য করার জন্য আলিমদ্দিন গঠন করেছেন স্বদেশি ডাকাতদল। সেই যুগেই পুঁজিপতিদের ত্রাস হয়ে উঠেছিল তারা। ইংরেজ সরকারের দমননীতির ফলে হেমচন্দ্র সহ একাধিক নেতা যখন জেলে, তখনও ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনকে অক্সিজেন জুগিয়েছেন আলিমদ্দিন। নিজে ছিলেন একজন ধর্মপ্রাণ মুসলিম। ছদ্মবেশে একের পর এক বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন। এমনকি পুলিশি ধরপাকড়ের কারণে আত্মগোপন করেও চালিয়ে গেছেন ব্রিটিশ বিরোধী কার্যকলাপ। কিন্তু ব্রিটিশ পুলিশ কোনোদিন তার টিকিও স্পর্শ করতে পারেনি।সাল ১৯২০। যক্ষ্মা রোগে বেশ কিছুদিন ভোগার পর চলে গেলেন মাস্টারসাহেব। পরবর্তীকালে তার নামানুসারে মধ্য কলকাতার একটি রাস্তার নামকরণ করা হল ‘আলিমুদ্দিন স্ট্রিট।’ খানিক বিকৃতই হল ‘আলিমদ্দিন’ নামটি। মাস্টারসাহেবের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে শেষ হল ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক বর্ণময় অধ্যায়।