দেশ 

একনজরে দেশের সফল রাজনীতিবিদ এবং হিন্দু জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দল বিজেপি-র প্রতিষ্ঠাতা, প্রথম সভাপতি এবং ওই দলের প্রথম প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী

শেয়ার করুন
  • 3
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  

বিশেষ প্রতিবেদক : অটলবিহারী বাজপেয়ী ভারতের রাজনীতিতে এক বিস্ময়কর প্রতিভা । দেশের সংসদে ১৯৫৭ সাল থেকে তিনি একটানা সাংসদ ছিলেন । হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল ভারতীয় জনতা পার্টির তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রথম সভাপতি । নিজের একক প্রচেষ্টায় বন্ধু লালকৃষ্ণ আদবানীর মত গুটিকয় নেতাকে  নিয়ে ভারতীয় জনতা পার্টিকে দেশের প্রথম সারির রাজনৈতিক দলে পরিণত করেছিলেন তিনি। নিজে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি করলে রাজধর্ম পালনে তিনি অনেকটাই নিরপেক্ষ থাকতেন। ১৯৮০ সালে বিজেপি দল প্রতিষ্ঠাতা করে মাত্র ১৬ বছরের মধ্যেই তাঁর নেতৃত্বে কেন্দ্রে সরকার গঠন করতে সমর্থ হয়েছিলেন। মাত্র ৬ বছরের কিছু বেশি সময় দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অটলবিহারী বাজপেয়ী একজন যোগ্য প্রশাসক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। জওহরলাল নেহেরু, ইন্দিরা গান্ধীর পর আজও অটলবিহারী বাজপেয়ীকে সফল প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রাষ্ট্রবিঞ্জানীরা চিহ্নিত করে থাকেন। তিনি একমাত্র ভারতীয় রাজনীতিবিদ যিনি সুস্থ থাকা সত্ত্বে সংসদীয় রাজনীতি থেকে অবসর নেওয়ার কথা ঘোষণা করেছিলেন। ২০০৫-এ সংসদীয় রাজনীতি থেকে অবসর নেওয়ার পর অটলবিহারী বাজপেয়ীকে আর কোনো দিন কোনো রাজনৈতিক মঞ্চে এমনকি আরএসএস মঞ্চেও তাঁকে দেখা যায়নি । ভারতীয় রাজনীতিতে যা ব্যতিক্রমী হিসাবে চিহ্নিত হয়ে আছে।৯৩ বছর বয়সী বাজপেয়ী গত ৯ সপ্তাহ ধরে এইমসে চিকিৎসাধীন। শেষ পর্যন্ত জীবনকে হার মানতে হল চলে গেলেন দেশের অন্যতম সফল প্রধানমন্ত্রী  অটল বিহারী বাজপেয়ী।

জন্ম : বাজপেয়ীর জন্ম ১৯২৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর গোয়ালিয়রে । বাবা ও মায়ের নাম কৃষ্ণ বিহারী বাজপেয়ী ও কৃষ্ণা দেবী। তাঁর ঠাকুরদা পণ্ডিত শ্যামলাল বাজপেয়ী উত্তরপ্রদেশের বাতেশ্বরের গ্রাম থেকে গোয়ালিয়রের মোরেনায় চলে আসেন। বাবা কৃষ্ণ বিহারী গ্রামের স্কুলের শিক্ষক ও কবি ছিলেন। কবিতার শখ সেখান থেকেই এসেছে অটলের মধ্যে।

Advertisement

শিক্ষা :  গোয়ালিয়রের সরস্বতী শিশু মন্দির থেকে পড়াশোনা করেছেন। পরে গোয়ালিয়রের ভিক্টোরিয়া কলেজে পড়েন।  এরপরে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে প্রথম শ্রেণি সহ স্নাতকোত্তর পাশ করেন কানপুরের ডিএভি কলেজ থেকে।

সমাজসেবায় যোগদান : আর্য সমাজের যুব শাখা আর্য কুমার সভা থেকে সমাজসেবায় অংশ নেওয়া শুরু বাজপেয়ীর। ১৯৪৪ সালে তিনি আর্য সমাজের সাধারণ সম্পাদক নিযুক্ত হন। আর ১৯৩৯ সালে আরএসএসে যোগ দেন তিনি।

 স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ : ১৯৪৭ সালে পূর্ণ সময়ের আরএসএস কর্মী হন বাজপেয়ী।স্বাধীনতা আন্দোলনে হাতেখড়ি ১৯৪২ সালে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে স্বাধীনতা আন্দোলন তথা রাজনীতিতে হাতেখড়ি হয় বাজপেয়ীর। সেইসময়ে ২৩ দিন গ্রেফতার করে রাখা হয়েছিল বাজপেয়ী ও তাঁর দাদা প্রেমকে। পরে মুচলেখা দেন যে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে তাঁরা থাকবেন না। সেই শর্তে ছাড়া পান। ফলে স্বাধীনতা আন্দোলনে তেমনভাবে অটলবিহারী বাজপেয়ীকে দেখা যায়নি।

জনসংঘে যোগদান ও শ্যামাপ্রসাদের ঘনিষ্ঠ :  মহাত্মা গান্ধীর হত্যার অভিযোগে আরএসএস-কে নিষিদ্ধ করা হলে ১৯৫১ সাল থেকে নতুন তৈরি হওয়া ভারতীয় জন সংঘের হয়ে কাজ শুরু করেন বাজপেয়ী। খুব শীঘ্রই তিনি শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন।

সংসদে প্রবেশ :  দেশের দ্বিতীয় সাধারণ নির্বাচনেই অটলবিহারী বাজপেয়ী অংশগ্রহণ করেন। ১৯৫৭ সালে প্রথমবার লোকসভা নির্বাচনে ভোটে দাঁড়ান অটল বিহারী বাজপেয়ী। মথুরা থেকে দাঁড়িয়ে রাজা মহেন্দ্র প্রতাপের কাছে হেরে যান তিনি। তবে অন্য একটি আসনে বলরামপুর থেকে জিতে সংসদে যান। তাঁর ভাষণ এতটাই যুক্তিনিষ্ঠ এবং বলিষ্ঠ যা প্রভাবিত করেছিল তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুকেও।

 জনসংঘের প্রধান : জাতীয় সভাপতি সাংগঠনিক দিক থেকে অত্যন্ত প্রভাবশালী ও দক্ষ প্রশাসক অটল বিহারী খুব তাড়াতাড়ি জন সংঘের মুখ হয়ে ওঠেন। দীনদয়াল উপাধ্যায়ের মৃত্যুর পরে ১৯৬৮ সালে দলের জাতীয় সভাপতি হন তিনি। নানাজি দেশমুখ, বলরাজ মোদক, লালকৃষ্ণ আডবাণীকে সঙ্গে নিয়ে জনসংঘকে এগিয়ে নিয়ে যান তিনি।

গ্রেপ্তার বরণ : ১৯৭৫ সালে জরুরি অবস্থার সময়ে গ্রেপ্তার হন বাজপেয়ী। ১৯৭৭ সালে জেল থেকে বেরিয়ে  জয়প্রকাশ নারায়ণের আহ্বানে কংগ্রেস বিরোধী জোট যা জনতা পার্টি নামে পরিচিত ছিল, তাতে জনসংঘ নিয়ে বাজপেয়ী যোগ দেন।
প্রথম কেন্দ্রীয় মন্ত্রী :  ১৯৭৭ সালে লোকসভা নির্বাচনে জিতে জনতা পার্টি জোটের সরকার হলে প্রধানমন্ত্রী হন মোরারজী দেশাই। বিদেশ মন্ত্রী নির্বাচিত হন অটল বিহারী বাজপেয়ী। প্রথম বিদেশ মন্ত্রী হিসাবে রাষ্ট্রসংঘের মঞ্চে হিন্দিতে ভাষণ দেন তিনি।

বিজেপির প্রতিষ্ঠাতা :  ১৯৮০ সালে আরএসএস-এর প্রচারক বাজপেয়ী দীর্ঘদিনের বন্ধু লালকৃষ্ণ আডবাণী, ভৈরো সিং শেখাওয়াতকে সঙ্গে নিয়ে বিজেপি তৈরি করেন। তিনি হন বিজেপির প্রথম সভাপতি। ইন্দিরা গান্ধী তথা কংগ্রেসের নীতির প্রবল সমালোচক ছিলেন তিনি।
বাজপেয়ী ও বিজেপি-র উত্থান :  ১৯৮৪ সালের নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিজেপি মাত্র ২টি লোকসভা আসনে জয়ী হন। তবুও সংসদে কংগ্রেসের বিরোধী নেতা বলতে সবার আগে বাজপেয়ীর নাম লোকের মুখে মুখে ঘুরত। ধীরে ধীরে অযোধ্যা ও রাম জন্মভূমি ইস্যুকে হাতিয়ার করে রাজনৈতিকভাবে সারা দেশে বিজেপি ছড়িয়ে যায়। ১৯৯৫ সালে গুজরাত ও মহারাষ্ট্রে জয়ের পরে বিজেপি অনেক শক্তিশালী হয়ে যায়। ততদিনে বাজপেয়ীকে প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী ঘোষণা করে দিয়েছে বিজেপি। আর দলের সভাপতি বনে গিয়েছেন আডবাণী।

প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ী :  ১৯৯৬ সালের লোকসভা নির্বাচনে জেতে বিজেপি। সবচেয়ে বেশি আসন পায়। বাজপেয়ী দশম প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথ নেন। তাঁকে সরকার গড়তে ডাকেন রাষ্ট্রপতি শঙ্কর দয়াল শর্মা। তবে অন্য দলগুলি বাজপেয়ীকে সমর্থন না করায় মাত্র ১৩দিনের মাথায় তিনি পদত্যাগ করেছিলেন।
১৯৯৮ সালের নির্বাচনেও বিজেপি জেতে। ১৩ মাসের সরকার হয়। সেবারও প্রধানমন্ত্রী হন বাজপেয়ী। তবে ১৯৯৯ সালে এআইএডিএমকে নেত্রী জয়ললিতা সরকারের উপর থেকে সমর্থন তুলে নিলে বাজপেয়ীর সরকার পড়ে যায়। লোকসভায় মাত্র একটিমাত্র ভোটের কারণে আস্থাভোট হেরে যায় বিজেপি।

১৯৯৯ সালে ফের লোকসভা নির্বাচন হয়। কার্গিল যুদ্ধ ও পোখরানে পরমাণু নিরীক্ষণের পরের এই ভোটে বিজেপি জোট ৫৪৩টি আসনের মধ্যে ৩০৩টি আসনে জেতে। ১৯৯৯ সালের অক্টোবর মাসে বাজপেয়ী তৃতীয়বারের জন্য প্রধানমন্ত্রী হন। ২০০৪ সাল পর্যন্ত পূর্ণ সময়কাল সরকার চালান।

অটলবিহারী বাজপেয়ীর পরাজয় : সফলভাবে ১৯৯৯ সাল থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত কেন্দ্র সরকার পরিচালনা করার পর অনেক ভাল কাজ তিনি করেছিলেন তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্ত  ২০০৪ সাধারণ নির্বাচনের সময় যখন মনে হয়েছিল, বিজেপি সহজেই জিতে যাবে, সেবার বিজেপি-র ভরাডুবির সঙ্গে সঙ্গে তার শরীকদেরও ভরাডুবি হয়েছিল। সোনিয়া গান্ধীর নেতৃত্বে কংগ্রেস তখন হয়ে যায় সবচেয়ে বড় দল। কেন্দ্রে তখন তৈরি হয় ইউপিএ জমানা। বামেরা বাইরে থেকে সমর্থন দেয় কংগ্রেসকে। বাজপেয়ী বিরোধী নেতৃত্বের ভার আডবাণীর উপরে দিয়ে দেন।
সক্রিয় রাজনীতি থেকে অবসরের ঘোষণা : দেশের রাজনীতি এক নজীর তৈরি করেছিলেন তিনি । সরাসরি রাজনীতি থেকে অবসরের কথা ঘোষণা করেন তিনি। ২০০৫ সালের পর থেকে সক্রিয় রাজনীতি অবসরের ঘোষণা করেন বাজপেয়ী। কোনওদিন সাধারণ নির্বাচনে লড়বেন না বলেও জানান। আগামিদিনে আডবাণী ও প্রমোদ মহাজনকে বিজেপির উত্তরাধিকার সঁপে দেন তিনি।

 ভারতরত্ন : নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর ২০১৫ সালে ভারত সরকার অটল বিহারী বাজপেয়ীকে ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ সম্মান ভারত রত্ন সম্মানে ভূষিত করা হয়। ১৯৯২ সালে তিনি পদ্মবিভূষণ পান। এছাড়া ১৯৯৪ সালে লোকমান্য তিলক পুরস্কার, ২০১৫ সালে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা পুরস্কারের মতো বহু দেশি-বিদেশি সম্মাননা বাজপেয়ী পেয়েছেন।

 


শেয়ার করুন
  • 3
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  

সম্পর্কিত নিবন্ধ

Leave a Comment

two × one =