আন্তর্জাতিক 

ইসরাইল ফিলিস্তিন যুদ্ধ বিরতিতে কার জয় ? কার পরাজয় ? নেপথ্য রহস্য জানতে হলে? এই লেখাটি পড়ুন

শেয়ার করুন
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  

তায়েদুল ইসলাম : এগারো দিন ব্যাপী ফিলিস্তিন ইসরাইল যুদ্ধের বিরতি হয়েছে। বন্ধ হয়নি। বলা যেতে পারে আপাতত বন্ধ হয়েছে। কোন জয় পরাজয়ও হয়নি। এর চূড়ান্ত বিজয় তখনই হবে যখন পাশ্চাত্যের অবৈধ সন্তান যায়নবাদি ইসরাইল নামক রাষ্ট্রটি পৃথিবীর মানচিত্র থেকে মুছে যাবে।

কিন্তু অনেকেই এই যুদ্ধ বিরতিকে ফিলিস্তিনের বিজয় হিসেবে দেখছেন। এখন প্রশ্ন হল, যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাব কে দিয়েছিল? সে কি ইসরাইল পক্ষের? ইসরাইলের ক্ষয় ক্ষতি কি ফিলিস্তিনের থেকে বেশি হচ্ছিল? তা-ই ক্ষয় ক্ষতির হাত থেকে বাঁচার জন্য এ পদক্ষেপ নিল। নাকি চূড়ান্ত পরাজয়ের দিকে এগোচ্ছিল? সে কারণে চূড়ান্ত পরাজয় থেকে রক্ষা পেতে যুদ্ধ বিরতি করতে বাধ্য হল?

Advertisement

আগের সব কয়টি যুদ্ধের অভিজ্ঞতা বলছে সব যুদ্ধের শেষে ইসরাইল কিছুটা এগিয়েছে বৃহত্তর ইসরাইল রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্য অর্জনের পথে। সব যুদ্ধ বিরতি বা বন্ধ ছিল এগিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে কৌশল।

এই যুদ্ধে ইসরাইল এর সৈন্য মরেছে এক ডজনের আশেপাশে। ফিলিস্তিনি শহীদ হয়েছেন প্রায় শ’তিনেক। ইসরাইল যুদ্ধের আন্তর্জাতিক নিয়মকানুনের কোন তোয়াক্কাই করেনি। শহীদ করেছে অর্ধ শতাধিক শিশু। আল জাজিরা সংবাদ মাধ্যমের কেন্দ্রকে ধুলিসাৎ করে দিয়েছে। বিস্তীর্ণ অঞ্চল বিধস্ত করেছে । এত কিছুর পরেও ইসরাইলের পরাজয় হল কী করে? আসলে ফিলিস্তিনের পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থনের বৃদ্ধিকে থামিয়ে দেওয়ার জন্যই কৌশল হিসেবে এই যুদ্ধ বিরতি।

 

যায়নবাদি ইহুদিদের বিশ্বাস ( সব ইহুদিদের নয়) তারাই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম জাতি। পৃথিবীকে শাসন করার অধিকার কেবলমাত্র তাদেরই। যেমন মনে করে ভারতীয় আর্য বা বামুনরা । সেই জন্য তারা বিশ্বব্যাপী ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চায় যা সারা বিশ্বের উপর শাসন কর্তৃত্ব পরিচালনা করবে। সেই লক্ষ্যে মধ্য প্রাচ্যে একটি বৃহত্তর ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা তাদের স্বপ্ন ও আশা আকাঙ্খা। তাদের বিশ্বাস অনুযায়ী , ফিলিস্তিনের বুক থেকে এ হুকুমতের উদ্ভব ঘটবে । রচিত পরিকল্পনা অনুযায়ী , মিশরের নীলনদের পূর্ব তীর থেকে শুরু করে লোহিত সাগরের তীর পর্যন্ত সিনাই উপদ্বীপ, ফিলিস্তিন, জর্দান,সিরিয়া, ইরাকের বেশিরভাগ ,পারস্য উপসাগরের একটি প্রবেশ পথ এবং মদিনা সহ সৌদি আরবের পশ্চিমাংশ নিয়ে হবে এই বৃহত্তর ইসরাইল। এই অংশটি সবচেয়ে মূল্যবান ভূগর্ভস্থ প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ। এই অংশটির কর্তৃত্বভার দখল করতে পারলে গোটা পৃথিবীকে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। তারা মনে করে এ এলাকার ক্ষমতা পরিচালনা করা বিশ্ব ব্যবস্থা পরিচালনার সমার্থক হবে।

ইউরোপ ক্রুসেড যুদ্ধের স্মৃতি, আতঙ্ক ভয় মুছে ফেলতে পারছে না। এখনো আতঙ্ক ও ভয়ে রয়েছে যে আবার ইসলাম ও মুসলিমরা ইউরোপ জয় করবে। ইউরোপ মূলতঃ ইহুদি ও খ্রিস্টানদের লড়াই এর ইতিহাস। ইহুদিদের উপদ্রব থেকে ইউরোপকে নিরাপদ রাখতেই ইউরোপ ফিলিস্তিনে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে দেয়।

আজকে ফিলিস্তিনে যায়নবাদিরা যে আঘাত হানছে তা কেবলমাত্র ফিলিস্তিনের মুসলিমদের উপর আঘাত নয়। এ আঘাত বিশ্ব মুসলিম ও ইসলামের উপর আঘাত। তাদের মর্যাদা ও সম্মান এবং ঐক্যের এর উপর আঘাত। পাশাপাশি এ আঘাত শুধু মাত্র মুসলিমদের উপর নয়। এ আঘাত হল বিশ্বের প্রতিটি মুক্তি আন্দোলনের উপর আঘাত। প্রতিটি আত্ম নিয়ন্ত্রণের লড়াই এর উপর আঘাত। প্রতিটি নিপীড়িত জনগোষ্ঠির উপর আঘাত। প্রতিটি মানবাধিকার আন্দোলনের উপর আঘাত। ফিলিস্তিনিদের লড়াই এর সাথে বিশ্ব মুসলিম এবং প্রতিটি মজলুম নিপীড়িত নির্যাতিত জনগোষ্ঠির ভাগ্য জড়িত। আজকে ফিলিস্তিনে যা ঘটছে গতকাল কসোভো, বসনিয়া, সার্বিয়ায় তা ঘটেছে। আজকে ঘটছে কাশ্মীর, মায়ানমার,উইঘোরে। কালকে ঘটবে আমাদের ক্ষেত্রে। এখনই আমাদের সতর্ক হতে হবে। ফিলিস্তিনিদের কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। বুঝতে হবে রোহিঙ্গারা কেন দাঁড়াতে পারলেন না। ফিলিস্তিনিরা কেন এখনো লড়ে যাচ্ছেন।

আমেরিকার বিখ্যাত রাজনৈতিক বৈজ্ঞানিক স্যামুয়েল পি হান্টিংটন ১৯৯৩ এ ” দ্য ক্ল্যাশ অফ সিভিলাইজেশন” এবং ১৯৯৬ তে ” দ্য রিমেকিং অফ ওয়ার্ল্ড অডার” দুটি বিতর্কিত বই লেখেন। তিনি দেখান বিশ্ব বিভিন্ন সভ্যতার মধ্যে দ্বন্দ্বের দিকে এগিয়ে চলেছে। এ বিশ্লেষণ তত্ত্বগত ভাবে ঠিক। এ দ্বন্দ্ব বিশ্বাস ও চিন্তা জগতে প্রবাহমান থাকবে। কিন্তু তা স্বত্ত্বেও ভিন্ন বিশ্বাস ও চিন্তা ভাবনা নিয়েই সহাবস্থানের মধ্য দিয়েই এগিয়ে যেতে হবে। এটাই সভ্যতার ভবিষ্যত। ব্যক্তির ক্ষেত্রে যেমন ঠিক তেমনি সভ্যতার ক্ষেত্রেও ঠিক। বিভিন্ন রকমের মূল্যবোধ একই রকম বা সমান গুরুত্বের সঙ্গে বিশ্বে শান্তিপূর্ণ ভাবে সহাবস্থান করা সম্ভব। ইসরাইল রাষ্ট্র গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করার আগে ফিলিস্তিনে এটাই ছিল। মুসলিম ইহুদি খৃস্টান সবাই শান্তিপূর্ণ ভাবে পাশাপাশি বসবাস করতেন। সমস্যা শুরু হল যখন যায়নবাদিরা পশ্চিমা শক্তির মদতে মুসলিমদের নিজ ভূমি থেকে নির্যাতন করে উচ্ছেদ করা শুরু করে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর তুরস্ক খেলাফতের পতন ঘটে যদিও তা নামে খেলাফত ছিল। প্রকৃতপক্ষে তা ছিল খেলাফতের জীবাশ্ম বা ফসিল। সে সময় বৃটিশ ও ফ্রান্স তুরস্ক সাম্রাজ্যকে টুকরো টুকরো করে ভেঙে দেয় এবং নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয়। নিজেদের উপনিবেশ গড়ে তোলে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে মুসলিম দেশগুলো স্বাধীন হতে শুরু করে। কিন্তু উপনিবেশ বা রাজনৈতিক পরাধীনতা থেকে মুক্তি লাভ করলেও তারা কার্যত পরাশক্তিসমূহের তাবেদার থেকে যায়। শাসন ক্ষমতায় থেকে যায় কোথাও রাজতন্ত্রের রাজা বাদশাহরা, কোথাও একনায়কতন্ত্রের রাজা বাদশাহরা। গত শতাব্দীর সাতের দশকের শেষে ইরানে ইসলামী বিপ্লবের মধ্য দিয়ে রাজতন্ত্রের অবসান ঘটে। তুরস্কে কোন বিপ্লব না ঘটলেও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ধীরে ধীরে বৃহৎশক্তিসমূহের প্রভাব মুক্ত হওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বাকি দেশগুলো বৃহৎশক্তির অঙ্গুলি হেলনে চলতে বাধ্য হচ্ছে। ফলে মুসলিম দেশগুলোর বিজ্ঞান প্রযুক্তিতে কোন উন্নয়ন হয়নি। ইউরোপ যখন শিল্পবিপ্লবের মধ্য দিয়ে নবজাগরণের সূচনা করে এবং উন্নতির পথে এগিয়ে চলে তখন মুসলিম বিশ্ব শিল্পবিপ্লব থেকে মুখ ফিরিয়ে থেকেছে। কোন গুরুত্ব দেয়নি। আজকে ইউরোপ যখন শিল্পবিপ্লবের যুগ পার হয়ে তথ্য প্রযুক্তির যুগে প্রবেশ করেছে তখন মুসলিমরা বিজ্ঞান প্রযুক্তির গুরুত্ব অনুধাবন করতে শুরু করেছে। এমনকি অবস্থা এমন পর্যায়ে আছে মুসলিমরা আত্মরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র এবং প্রশিক্ষণ তাদের শত্রুদের কাছ থেকে নিতে বাধ্য হচ্ছে। কুরআনের শিক্ষা মূলতঃ বিজ্ঞান প্রযুক্তি এবং আত্মরক্ষার জন্য নির্দেশকে অমান্য করার পরিণতি এটা।

এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য মুসলিমদের যা করা দরকার তার কয়েকটি হল ১ ) মুসলিম দেশগুলোতে ইসলামী বিপ্লবের মাধ্যমে শাসক এবং শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তন করতে হবে। ইসলামী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা নতুন প্রজন্মের নেতাদের ক্ষমতায় বসতে হবে। ২) শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করে সর্বাধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে উন্নতি করতে হবে। ৩) ধনী ও উন্নত দেশগুলোকে তুলনামূলক ভাবে অনূন্নত দেশসমূহে সর্ব প্রকার সাহায্য-সহযোগিতা করতে হবে। স্থায়ী উন্নয়নের জন্য। দান খয়রাত এর মাধ্যমে গরীব করে রাখা বন্ধ করতে হবে। ৪) মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে স্বার্থের দ্বন্দ্ব, আদর্শগত সংঘাত এবং আধিপত্য বিস্তারের বাসনা বৃহত্তর ঐক্য গঠনের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে রেখেছে। এ সব থেকে বেড়িয়ে আসার জন্য অব্যাহত প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।

সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা ও কর্মসূচি বাস্তবতার নিরিখেই করতে হবে। এ কথাও মনে রাখতে হবে বিছিন্ন নিস্ফল হিংসাত্মক অপরিকল্পিত আবেগ সর্বোস্ব কাজের মধ্য দিয়ে ক্রোধ হতাশা দাবি দাওয়ার প্রকাশ বাস্তব সম্মত নয়। ইসরাইল এর ধর্মীয় রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সামরিক শক্তি এবং আমেরিকার নেতৃত্বে পশ্চিমা শক্তির নির্লজ্জ সমর্থন এর বাস্তবতাকে মাথায় রেখেই পরিকল্পনা গ্ৰহণ করতে হবে।

ইসলামী বিপ্লবের মহান নেতা ১৯৮৩ সালেই ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধান এর দিক নির্দেশনা দিয়েছেন। ” আমাদের জনগণ,তথা বিশ্বের সমগ্ৰ মুসলিম ও মুস্তাজআ’ফ ( বঞ্চিত) জনগণ গর্বিত যে, তাদের দুশমন যারা মহান আল্লাহ তাআলা, কুরআনে কারীম ও প্রিয় দীন ইসলামের দুশমন, তারা হচ্ছে সেই হিংস্র পশুর দল যারা স্বীয় ঘৃণ্য পৈশাচিক লক্ষ্যে উপনীত হবার জন্য কোন রকমের নৃশংসতা ও বিশ্বাসঘাতকতার আশ্রয় নিতে দ্বিধা করে না এবং ক্ষমতা দখল ও ক্ষমতা লিপ্সা চরিতার্থ করার ক্ষেত্রে শত্রু মিত্র কোন কিছুর ভেদাভেদ করে না , আর এদের শীর্ষে রয়েছে স্বভাবজাত রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদী আমেরিকা- যে সরকার সারা বিশ্বে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে এবং তার দোসর হচ্ছে আন্তর্জাতিক ইয়াহুদীবাদী চক্র – যারা স্বীয় অপরাধী লক্ষ্য হাসিল করার জন্য এমন সব পৈশাচিক অপরাধে লিপ্ত হচ্ছে যার বর্ণনা প্রদানেও লেখনী ও রসনা লজ্জা অনুভব করে; বৃহত্তর ইসরাইল ( প্রতিষ্ঠার) বোকামি কল্পনা তাদেরকে যে কোন নৃশংস অপরাধ সংঘটনেই প্রবৃত্ত করছে। হে বিশ্বের মুস্তাজআফ জনগণ! হে মুসলিম দেশসমূহ!! হে বিশ্বের মুসলিম জনগণ!!! উঠে দাঁড়ান, সত্যকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরুন, পরাশক্তি বর্গ ও তাদের পদলেহী দালালদের প্রচার হট্টোগোলে সন্ত্রস্ত হবেন না, আর যে অপরাধী শাসকগোষ্ঠী আপনাদের কষ্টার্জিত সম্পদ ” আপনাদের ও প্রিয় ইসলামের ” দুশমনদের হাতে তুলে দিচ্ছে, তাদেরকে আপনাদের দেশ থেকে তাড়িয়ে দিন , আপনারা নিজেরা ও নিষ্ঠাবান জনসেবক শ্রেনী দেশের নিয়ন্ত্রণ ভার গ্রহণ করুন আর সবাই মিলে ইসলামের গৌরবময় পতাকা তলে সমবেত হয়ে ইসলাম ও বিশ্বের স্বাধীন সার্বভৌম প্রজাতন্ত্রের সমন্বয়ে ইসলামী সরকার প্রতিষ্ঠার দিকে এগিয়ে যান- যার বাস্তবায়নের মাধ্যমে আপনারা বিশ্বের সমস্ত দাম্ভিক পরাশক্তিকে স্বস্থানে বসিয়ে দিতে পারবেন, সমগ্ৰ মুস্তাজআফ জনগণকে পৃথিবীর নেতৃত্বের উত্তরাধিকারিতে পরিণত করতে সক্ষম হবেন। আল্লাহ তা’আলার প্রতিশ্রুত সে দিবসের আশা পোষণ করছি।


শেয়ার করুন
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  

সম্পর্কিত নিবন্ধ

Leave a Comment

18 + fifteen =