অন্যান্য 

দেশভাগের পর অবিভক্ত বঙ্গে যারা ছিল সংখ্যাগুরু , পেনের আঁচড়ে এক লহমায় তারা হয়ে গেল সংখ্যালঘু : ড. আবদুস সাত্তার

শেয়ার করুন
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  

বামফ্রন্ট সরকারের শেষ পাঁচ বছর রাজ্যের সংখ্যালঘু উন্নয়ন ও মাদ্রাসা শিক্ষা দফতরের প্রতিমন্ত্রী ছিলেন ড. আবদুস সাত্তার । তিনি মাত্র পাঁচ বছরে রাজ্যের সংখ্যালঘুদের উন্নয়নের মোড়কে ঘুরিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন । সফল মন্ত্রী হিসাবে আজও তাঁকে রাজ্যের সংখ্যালঘুরা উদাহরণ হিসাবে তুলে ধরে । সেই আবদুস সাত্তার এবার বাংলার জনরব নিউজ পোর্টালের মুখোমুখি । এটা কোনো প্রথাগত সাক্ষাৎকার নয় । এটা ফেলে আসা অতীতের ঐতিহাসিক দলিল । বেশ কয়েকটি কিস্তিতে বৃহস্পতিবার ও রবিবার প্রকাশিত হবে । অষ্টাদশ কিস্তি ।

প্রশ্ন : নবাব আবুদল লতিফ ভবন, রোকেয়া ভবন , একে ফজলুল হক কর্মরত মুসলিম মেয়েদের হস্টেল , স্যার আজিজুল হক ছাত্রাবাস , বঙ্গবন্ধু ছাত্রাবাস , মৌলানা আবুল কালাম আজাদ ভবন , অম্বর ভবন – বহু বাড়ি তৈরি করলেন এবং মুসলিম মনীষিদের নাম যুক্ত করলেন , ইতিপূর্বে এতজন মনীষির নাম সংযুক্ত করা হয়নি-এ বিষয় যদি কিছু বলেন ?

Advertisement

আবদুস সাত্তার : আপনার প্রশ্নে দুটো বিষয় একাত্ম হয়ে আছে । প্রথমত, ছাত্রাবাস ও শিক্ষাসংক্রান্ত ভবন, দ্বিতীয়টি কেন মনীষিদের নাম যুক্ত করলাম। তাই তো – প্রথম বিষয়টির উত্তরে জানাই ইংরেজ শাসনাধীন সময়ে কলকাতা শহরে এলিয়ট, কারমাইকেল, বেকার ছাত্রাবাস মূলত মুসলিম ছাত্রদের জন্য তৈরি হয়েছিল । স্বাধীনতার পর আর কোনো নতুন ছাত্রাবাস তৈরি হয়নি । যদিও বামফ্রন্ট সরকারের আমলে পার্কসার্কাসে মুসলিম মেয়েদের জন্য ছাত্রী নিবাস তৈরি হয় । এর কারণও দেশভাগে নিহিত । অবিভক্ত পূর্ববঙ্গ থেকেও প্রচুর সংখ্যক ছাত্র কলকাতা শহরে আসত । কেননা, কলকাতা-ই সেই সময় শিক্ষার আলোকপ্রাপ্ত শহর ছিল । রাজধানী, নবজাগরণের পৃষ্ঠভূমিও বটে । ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি হওয়ার পর খানিকটা হলেও ভারসাম্যের পরিবর্তন হয়। পরবর্তী গবেষণায় জানা যাচ্ছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে একদল মুসলিম বুদ্ধিজীবীর আর্বিভাব ‘ধুমকেতু’-র মতো পরিলক্ষিত হচ্ছে । তারই ফলশ্রুতি ছিল ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’। বুদ্ধির মুক্তির আন্দোলন ; শিখা-জাগরণ-সওগাত-মোহম্মদী-লাঙল প্রভৃতি পত্রিকায় সমাজ-মানসে প্রতিবিম্বন । যার আর এক প্রতিচ্ছবি ১৯৫২-র ভাষা আন্দোলনে পূর্ণতা পেল , জন্ম নিল বিশ্বের ইতিহাসে প্রথম ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্র।পূর্বপাকিস্থান জন্মে ছিল ধর্মের ভিত্তিতে ; আর কয়েক বছরের কাল প্রবাহে ভাষার ভিত্তিতে বাঙালির জাতীয়তার সৌধ নির্মাণ , সেকুলার রাষ্ট্রে অভিনন্দিত। বাংলা ভাষা-ভাষীদের আপণ কর্ষণভূমি । বাংলাদেশ । ‘আমার সোনার বাংলা , আমি তোমায় ভালবাসি’তে ভূষিত ।

যা বলছিলাম, দেশভাগের পর শিক্ষিত,আলোকিত, কর্মরত মুসলিমদের প্রায় সকলেই চলে গেলেন পূর্ব পাকিস্থানে।অবিভক্ত বঙ্গে যারা ছিলেন সংখ্যাগুরু , পেনের আঁচড়ে এক লহমায় তারা হয়ে গেল সংখ্যালঘু। সেই সময়কার অবস্থা বুঝতে শুধু একটি উদাহরণই যথেষ্ট হবে – আজকের মৌলানা আজাদ কলেজ । অবিভক্ত বঙ্গের প্রধানমন্ত্রী আবুল কাশেম ফজলুল হক দুটি কলেজ তৈরি করেছিলেন । মুসলিম ছাত্রদের জন্য ইসলামিয়া কলেজ আর মুসলিম মেয়েদের জন্য লেডি ব্রাবোর্ণ কলেজ । ১৯৪৭ সালের আগষ্ট মাসে ১৯৫৮-তে মৌলানা আজাদের মহাপ্রয়াণ অর্থাৎ দশ বছরের কিছু সময়ের মধ্যে ইসলামিয়া কলেজ থেকে সেন্ট্রাল কলেজ অতঃপর মৌলানা আজাদ কলেজে রূপান্তরিত হয়ে গেল । অথচ লেডি ব্রাবোর্ণ কলেজের নামকরণ একই থেকে গেল । তাই না?

প্রথমত, যারা এদেশে থেকে গেলেন তারা মূলত মুসলিম অধ্যুষিত গ্রামের বাসিন্দা । দ্বিতীয়ত, বেশিরভাগই গরীব , খেত মজুর ,চাষা । দেশ-কাল ভেদে তাদের জীবন-যাপনে কোনো পার্থক্য হয় না বলে তারা মনে করে। আর শহরের উর্দুভাষীরা কখনোই বাংলাভাষী পূর্বপাকিস্থানে বেশি পরিমাণে যায়নি ; ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে। কলকাতা শহরের জনবিন্যাসের পরিবর্তন দেখলে তা সহজেই ধরা পড়বে।শুরু হলো `Gheto’-বাসী জীবন-যাপন।১৯৭১-এ বাংলাদেশ নামক স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের জন্ম হওয়ার পর যা-ও বা কিছুটা পিছুটান ছিল তা উধাও হয়ে গেল । শুরু হল জীবন-সংগ্রামের এক নতুন অধ্যায় । স্বাধীনতা পরবর্তীকালে বেশ কিছু দাঙ্গা, খাদ্য , জমির লড়াই; অবশেষে ৬০-র দশকে শেষপ্রান্তে রাজনৈতিক ভারসাম্যের পট-পরিবর্তন । ১৯৭২-৭৭ এক অর্থে যেমন নৈরাজ্যের কাল,অপরদিকে আবার সংখ্যালঘু মুসলিমদের মনে বল-ভরসা জোগানোরও সময় সেই সময় প্রচুর ক্ষমতাবান মুসলিম মন্ত্রীর আগমনে সেই কাজটা আরও সুষ্ঠভাবে সম্পন্ন হয় । চাকুরির ক্ষেত্রেও প্রসারিত হতে থাকে । একথা ঠিক যে সেই সময় বেতনক্রম, ভাতা ইত্যাদি খুব একটা সুখকর বিষয় ছিল না ।

তবু রাজ্যের সংখ্যালঘু অধ্যুষিত জেলা , অঞ্চলগুলিতে আজো তার দীর্ঘমেয়াদী প্রভাবের চিহ্ন বর্তমান। এই ঘটনার রাজনৈতিক সুফল আজো সেই রাজনৈতিক দল পাচ্ছে । বামফ্রন্টের ৩৪ বছরেও তার ব্যতিক্রম হয়নি , এখনো একই আছে । সেই সময় শিক্ষিত , সম্পন্ন মুসলিম নেতৃবৃন্দ অনেক বেশি পরিমাণে সরকারে প্রতিনিধিত্ব করেছেন । গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রক তাঁরা অলঙ্কৃত করতেন। দল ও সরকারের আক্ষরিক অর্থেই তাঁরা ‘নেতা’ ছিলেন। সেই উত্তরাধিকার বাংলার মুসলিম সমাজের বড় আদরের ধন । বামফ্রন্টের ৩৪ বছর এবং অবশ্যই মমতা সরকারে সেই সময়ের তুলনায় ক’জন সেই উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন সরকারে মন্ত্রী ও দলের নেতা আছেন? অবস্থাটা এখন এমন হয়েছে যে, সংখ্যালঘু বিষয়ক ও মাদ্রাসা শিক্ষা দফতরের পূর্ণ-দায়িত্বও কোনো সংখ্যালঘু মানুষ পেতে সমর্থ হন না । (চলবে)

 


শেয়ার করুন
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  

সম্পর্কিত নিবন্ধ

Leave a Comment

2 × 1 =