জেলা 

পাচার হওয়া ৩০ মহিলার হাতে ত্রাণ সামগ্রী তুলে দিলো ভাষা ও চেতনা সমিতি

শেয়ার করুন
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  

সুব্রত গুহ  : উত্তর ২৪ পরগনা জেলার হাসনাবাদের ওরা তিরিশ জন মহিলা। হারিয়ে গিয়েছিলেন জীবনের মূলেস্রাত থেকে।কেউ কেউ পেটের খিদে মেটানোর জন্য একটা কাজের খোঁজে আবার কেউ কেউ প্রেমের জালে জড়িয়ে ঘর বাঁধার রঙিন স্বপ্নে বিভোর হয়ে। কিছু দিন পরে তারা বুঝতে পারেন, প্রতারণার ফাঁদে ফেলে তাদের পাচার করা হয়েছে। স্বপ্ন ভঙ্গের কষ্টকে বুকে চেপে আর অনেক বাধা-বিপত্তি কাটিয়ে কিছু সহৃদয় মানুষ আর স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সহায়তায় বাড়ি ওরা ফিরতে পারলেও এখনও ওরা ফেলে যাওয়া জীবনের মূলেস্রাতে ফিরতে পারেননি।

সে এক অন্য কাহিনি, অন্য গল্প। সে কাহিনি বা গল্পও কোন রোমাঞ্চকর উপন্যাসের চেয়েও কম আকর্ষণীয় নয়। তবে এমনই ৩০ জনের একজন সাবিনা (পরিবর্তিত নাম)। সাবিনা ও তার দুই বোন, মা-বাবা, দাদু দিদা ও কাকা-কাকিমার এক পুত্র সন্তানকে নিযে একটি ছোট্ট মাটির ঘরে বাস করত আমলানি গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে একটি ছোট গ্রামে। সাবিনাদের সংসারে দিন আনা দিন খাওয়া বাবা হাফিজুর গাজী জনমুজর খাটত, সবদিন কাজ হত না। সাবিনা যখন ১৫ বছর বয়স তখন বাবা-মা দুজনই কাজের জন্য চলে যায় মুম্বাইতে। বাবা রাজমিস্ত্রির জোগাড়ে করে আর মা রাঁধুনির কাজ করেন।

Advertisement

মা, বোনেরাও বাবা-মার সঙ্গে মুম্বইতে। তখন তারা খুব ছোট। সাবিনা তার আগে থেকে পড়াশোনায় মন বসাতে পারত না । বাবা কাজে যেত মা লেখাপড়া জানে না সাবিনা নিজের খেয়ালে আর স্কুল মুখী হয়নি । সপ্তম শ্রেণিতেই ইতি করে দেয়, যার জন্য সাবিনাকে কোন কথা শুনতে হয়নি।

সাবিনা ছোট বেলা থেকে শান্ত মেজাজের ছিল। বাবা-মা যখন চলে যায়, তখন একা হয়ে যায়। যোগাযোগের একটা ফোন উপহার দেয় বাবা ২০১৪ সালে। মা-বাবার সঙ্গে যোগাযোগ রাখার পাশাপাশি যোগাযোগ হয় মাখালগাছার ইস্তাক গাজির সাথে, অচেনা ফোন নম্বর ধরেই পরিচয়। পরিচয়ের পর পরই ইস্তাক প্রেমের গল্প শুরু করে। সেই গল্প ধীরে ধীরে সমৃদ্ধ হতে থাকে। একদিন ইস্তাক প্রস্তাব দেয় ‘তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচব না’ আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই, সাবিনা জানায় আমার বাবা-মা বাড়ি আসুক তুমি লোক পাঠাবে । ইস্তাক বলে ‘কবে তোমার বাবা-মা আসবে আর তারা যদি রাজি না হয় তার থেকে চল আমরা বসিরহাটে গিয়ে বিয়ে করে নিই।

সাবিনা ভাবতে ভাবতে রাজি হয়ে যায় । দিনক্ষণও ঠিক হয়ে যায়। নিজেদের পরিকল্পিত দিনেই হাসনাবাদ স্টেশনে হাজির হয়ে যায় সাবিনা, ইস্তাকরা। ট্রেনে বসে ইস্তাকের সাথে থাকা দুজনকে দেখে। ওরা দুজন কারা? আরিফা জিজ্ঞাসা করে। ইস্তাক জানায় বিয়ে করতে গেলে সাক্ষী লাগে তাই।

বসিরহাট স্টেশন পেরিয়ে যায় সাবিনা নামার কথা বললে, ইস্তাক বলে এখানে বিয়ে করলে লোক জানাজানি হয়ে যাবে আর এখানে তো কোন কাজ নেই, কী খাব ? আমরা তাই চলো দিল্লিতে যাই। ওখানে আমার মাসি আছে, আর ভালো কাজও পেয়ে যাব। ওখানেই বিয়ে করে নেব। অবশেষে পৌঁছে গেল দিল্লির দাদরিতে মাসির কাছে। সেখানে আট দিন ইস্তাক সাবিনার সাথে মিথ্যে সংসার করে বিয়ে ছাড়াই। বিয়ের কথা বললে, বলে, বিয়েতে তো কিছু খরচ আছে আমি কাজে যাচ্ছি তো। বিয়ে করে নেব।

ইস্তাক প্রতিদিন বেরিয়ে যেত রাতে ফিরত। আট দিন পর ইস্তাক বলে, আজ বিয়ে হবে আমাদের আমি শাড়ি ও কিছু জিনিসপত্র কিনতে যাচ্ছি। আর ফেরেনি ইস্তাক। সাবিনা অপেক্ষা করতে থাকে। ঐ রাতেই সাবিনাকে ৮০,০০০ টাকার বিনিময়ে তুলে দেয় এক ৬০ বছরের অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মীর হাতে। সাবিনা যেতে না রাজি হলে মাসি বলে তোকে ৮০,০০০ টাকায় বিক্রি করে গেছে ইস্তাক । তোর আর কোন উপায় নেই।

ওই রাতেই নিয়ে যায় অবসরপ্রাপ্ত অফিসার তার নিজের বাংলোতে । শুরু হয় অকথ্য শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার। শুধু অফিসার নিজে নয় তাঁর পরিচিত বন্ধু ও আর অনেকে আসতে থাকে বাংলোতে।সাবিনা বুদ্ধি বানাতে শুরু করে। ওদের সঙ্গে মিশে যায়। সুযোগ বুঝে মনে রাখা নম্বরে রিং করে কাকার কাছে। শুধু জানায়, ‘আমি খারাপ আছি আমাকে বাঁচাও।’’

বেশি কিছু বলার সুযোগ ছিল না। অফিসার যখন ওয়াশরুমে সেই সুযোগে ফোন। সাবিনা পরের দিনও ফোন করে। সাবিনার কাকা হাসনাবাদ থানায় আসে ‘কেয়া’কে জানায় এফআইআর হয়। থানা পুলিশ আজ যাই কাল যাই করে পেরিয়ে যায় আর পাঁচ দিন। এরপর ‘কেয়া’ র কর্ণধার নেটে খুঁজে নিয়ে দিল্লি এনজিও শক্তিবাহিনীর ফোন নম্বর । সঙ্গে সঙ্গে এফআইআর-সহ সব তথ্য ইমেল করে পাঠানো হয়। শক্তিবাহিনী সেই রাতে ওখানকার প্রশাসনের সহযোগিতায় উদ্ধার করে সাবিনাকে।

সাবিনার মতো হাসনাবাদের এমনই ৩০ জন পাচার হয়ে যাওয়া তরুণী ও মহিলাকে আজ করোনা ও আমফান ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী পরিস্থিতিতে তাদের হাতে ভাষা ও চেতনা সমিতির পক্ষ থেকে ত্রাণ সামগ্রী তুলে দেওয়া হয়। এক মাসের খাদ্য সামগ্রী হিসেবে চাল-ডাল-আটা-নুন-তেল-হলুদ-লঙ্কা-জিরা-সয়াবিন-সাবান দেওয়া হয় বলে ভাষা ও চেতনা সমিতির রাজ্য সম্পাদক অধ্যাপক ইমানুল হক জানিয়েছেন। অধ্যাপক ইমানুল জানান, খাদ্য সামগ্রী ছাড়াও শাড়ি, টর্চ, স্যানিটারি ন্যাপকিন‌‌‌ দেওয়া হল হাসনাবাদের পাচার হওয়া ৩০জন তরুণী ও মহিলার হাতে।


শেয়ার করুন
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  

সম্পর্কিত নিবন্ধ

Leave a Comment

seventeen − 11 =