ধান ভানতে শিবের গীত : অশোক ভট্টাচার্য রাজা
দুই বাংলায় বাংলা ভাষার নাকি আরবীকরণ হচ্ছে তা নিয়ে উদ্বিগ্ন কিছু ভক্ত । বাংলা ভাষার আরবীকরণ কি সমৃদ্ধির লক্ষণ ? নাকি ভাষার সজীবতার ক্ষেত্রে আত্তীকরণ ভা্ল দিক । এই নিয়েই তথ্যবহুল লেখাটি লিখেছেন অশোক ভট্টাচার্য রাজা । বাংলার জনরব-এর পাঠকদের উদ্দেশে এই লেখাটি প্রকাশ করা হল ।
তৌসিফের শিবঠাকুর এবং ভাষা দিবস পালন এবং দুই বাংলায় বাংলা ভাষার তথাকথিত ‘আরবীকরণ'(?) নিয়ে ভক্তকুল উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে।আর্যাবতের শিবের সাথে বাঙালির শিবের কোনোকালেই মিল ছিলো না। সপ্তদশ শতকে রতিদেবের লেখা ‘মৃগলুবদ্ধ'( ১৬৭৪), ১৬৮৪ তে রামকৃষ্ণ রায়-এর ‘শিবায়ন’ এবং অষ্টাদশ শতকের গোড়ার দিকে( ১৭১০-১১) রামেশ্বর চক্রবর্তীর ‘অষ্টমঙ্গলা’ কাব্যে যে শিবের ছবি আমরা পাই-সেই শিব কখনো ঘরোয়া স্বামী-স্ত্রী কোন্দলের স্বামী, সে কৃষক। একটু অলস,কাজে উদাসীন; সংসারে অভাব লেগেই আছে। ভিক্ষা করে সেখানে শিব। অকিঞ্চন,অনাসক্ত পুরাণের শিব কে ভিক্ষুক শিব হিসাবে গ্রহণ করতে সেদিন বাঙালির একটুও কুণ্ঠা হয়নি। সেই শিব তাদের কোচ-পাড়ায় কোচনীর সঙ্গে প্রেম করতে ব্যস্ত, কম যায় না পার্বতীও; মোহিনী বাগদিনীর বেশে ঠাকুরটিকে ঘাট মানিয়ে তবে সে ছাড়ে।
এরপরে তথাকথিত নিম্নস্তর থেকে মধ্যস্তরে শিবের প্রমোশন হলো। আগের যুগের উচ্চবর্রণের একটি অংশ ছিলো ব্রাহ্মণ, করণ রাজপুরুষ, বৈশ্য -এরা। উচ্চবর্ণের হলেও এরা সবাই উচ্চবর্গের নয়। তুর্ক বিজয়( ১২০৩ এর পরের সময়) -এর পর এই বৃত্তিজীবী উচ্চবর্ণ এবং ক্ষমতাচ্যুত হিন্দু উচ্চস্তরের একটা অংশ, এই নিয়ে বাঙালি হিন্দু মধ্যবিত্তের জন্ম হচ্ছিল তা বোঝা যায়। তারাই ছিলো বাংলা সাহিত্যের প্রধান ভিত্তি, লেখক ও শ্রোতা। তাই পরবর্তীকালের শিব একটু পালিশ করা শিব। সে সংসারের ভালো মানুষ কর্তাটি হয়ে ওঠে। কিন্তু বউয়ের সাথে কোঁদল থাকেই।
মোটমাট কথা মঙ্গল কাব্যের শিব হলো এক্কারে সাধারণ মানুষ। গাজন কিম্বা ধর্মপুরাণেও এই শিবকেই পাই। যে শিব বাঙালির উঠোনের শিব, লোকায়ত ভাব ও সংস্কৃতি যা বাংলা ও বাঙালির আবহমান ধারা, বাঙালির শিব তার বাইরে নয়। তৌসিফের আঁকা ছবিতেও সেই শিবকে পাই।
এখন প্রশ্ন, ধান ভানতে শিবের গীত কেন করছি এখানে?
ভক্তকুলের হোয়াটস অ্যাপ ইউনিভার্সিটিতে কিছু লেখা ঘোরাঘুরি করছে। বিগত দু তিন বছর ধরে ২১ শে ফেব্রুয়ারীর সময় এই লেখাগুলো ভক্তকুল অাওড়ে বেড়ান।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, কেন তারা এমন করে? কি লেখে তারা?
তারা লেখে–‘পানি’, গোসল’, ‘দোয়া’, ‘দাওয়াত ‘…এমনসব শব্দগুলো বাংলা ভাষার আরবীকরণ করে দিচ্ছে এবং সে কারণে বাংলা ভাষা নাকি বিপন্ন।
‘পানি’ শব্দটি কোনোকালেই আরবী বা অন্য কোনো বিদেশি শব্দ নয়; বরং খাঁটি দেশজ শব্দ এটি। বাংলা ভাষার প্রাতিষ্ঠানিক সূচনা লগ্ন থেকেই ( হাজার বছর আগে চর্যাপদের সময় থেকেই) ‘পানি’ শব্দটি বাংলা শব্দভাণ্ডারে লক্ষণীয়ঃ
“তেন ন চ্ছুপই হরিণা ন পিব পাণী” ( ভুসুকু পাদের পদ)।
আবার ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’-এর ‘যমুনাখণ্ডে বড়ু চণ্ডীদাস লিখছেন…
“তোহ্মার বোলে কেহ কাহ্নাঞি না বহিব পাণী..”
মধ্যযুগে মুকুন্দ চক্রবর্তী, লোচনদাস, আলাওল অবলীলায় ‘পানি’ শব্দ ব্যবহার করেছেনঃ
“বিরহ জ্বরে পতি যদি মরে/ কোন ঘাটে খাবে পাণী”( চণ্ডীমঙ্গল)
এবার প্রশ্ন, আগত আরবী, ফারসি, উর্দু শব্দগুলো নিয়ে। সেগুলো বাংলা শব্দভাণ্ডারে ঠাঁই করে নিয়েছে কালক্রমে অভিযোজনের নিয়ম মেনেই। ‘আদালত’, ‘দোয়াত’, ‘কাঁচি’ উচ্চারণ করলে কি বাংলা ভাষা বিপন্ন হয়ে যাচ্ছে?
রবীন্দ্রনাথ ‘কর্তার ভূত’-এ লিখছেন —
“শ্মশান থেকে মশান থেকে ঝোড়ো হাওয়ায় হাহা করে’ তার উত্তর আসে, “আব্রু দিয়ে, ইজ্জৎ দিয়ে, ইমান্ দিয়ে, বুকের রক্ত দিয়ে।”
—এই ‘আব্রু’, ‘ইমান’, ‘ইজ্জত’ এগুলোতো সবই আরবি, ফার্সি শব্দ; যা বাংলা শব্দ ভাণ্ডারে ঠাঁই করে নিয়েছে।
এই আত্তীকরণের ধারাই ভারতীয় সংস্কৃতির মূল বৈশিষ্ট্য, বাংলা যা থেকে ভিন্নতর নয়। এতে বাংলা ভাষা মরে নি, মরবেও না। বরং সচল থাকবে তার গতিধারা।
একটা ভাষা কখন মরে? খুব জটিল এ আলোচনার সহজতর একটা উত্তর এই যে, মানুষের মুখে যখন কোনো ভাষা ব্যবহার হারায় তখন সেই ভাষা মৃত্যুর দিকে ঢলে পড়ে।
এখন এই ভাষার মৃত্যুর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সংস্কৃতির একটা নিবিড়তম যোগ থাকবেইঃ
” Cuando muere una lengua
Se cierre a todos
los pueblos del mundo..” ( Aztec).. এর ইংরেজি অনুবাদ করেছিলেন John Ross…যার বাংলা করলে এই কবিতার ( When a Language Dies) একটা অংশে পাই…
” যখন ভাষার মৃত্যু হয়,
তখন শেষ হয়ে গেছে অনেক কিছু
আর অনেক কিছু হবে শেষ।
আয়না চিরতরে চূর্ণ হয়,
শব্দের প্রতিধ্বনি হয় চিরতরে নিস্তব্ধ।
মনুষ্যবোধও থমকে যায়
যখন ভাষার মৃত্যু হয়।”
এই যে শব্দ ভাণ্ডারে দেশি-বিদেশি শব্দের আসা- যাওয়া সেটাই তো মানুষের মুখে কোনো ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখে।
চমস্কি কোলকাতায় আসলে গঙ্গাবক্ষে আলাপন বন্দোপাধ্যায়কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ” ভাষা নদীর মতো, যেখানে গতিপথ রুদ্ধ হয়ে যায় সেখানেই মজে যায়( পড়ুন মারা যায়)।”
সুতরাং প্রথমে ভাষাকে অবলুপ্ত করো, তারপর সংস্কৃতিকে। তবেই শাসকের ষোলকলা পূর্ণ হবে।
শাসক তো কোনোকালেই বোকা নয়। সাংস্কৃতিক আধিপত্য কায়েম করতে পারলে শাসন ও শোষণ দুটোই মসৃণ হবে। সেই পথ ধরেই ওপার বাংলায় বাংলা ভাষার টুঁটি টিপে ধরার অপপ্রয়াস চালিয়েছিলো খান সেনারা। এটাই হলো সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের একাধিপত্য কায়েমের চেষ্টা। একই চেষ্টা আজ সংঘ পরিবার করে চলছে।
তৌসিফ মুসলিম হয়ে শিব এঁকেছেন বলে ততটা উদ্বিগ্ন নয় ভক্তকুল, বরং বেশি উদ্বিগ্ন ‘বাঙালি শিব’ সামনে এসেছে বলে।
ভাষা দিবস ও ২১ ফেব্রুয়ারীকে কটাক্ষ করে হেয়াটস অ্যাপ ইউনিভার্সিটির পোষ্টও সেই এক কারণেই করছে তারা।
ধর্ম দিয়ে কেবল শাসন করা সুবিধাজনক হলে খান সেনারা নিজ ধর্মের লোকগুলোকে ২১ ফেব্রুয়ারী ‘১৯৫২ তে গুলি করে মারত না।
আসলে ধর্ম দিয়ে কিস্যু হয় না,বরং সাংস্কৃতিক একাধিপত্য কায়েম করে শাসন-শোষণ দুটোই মসৃণতর হয়ে ওঠে। আর তাই ‘এক দেশ-এক ভাষা -এক ধর্মে’র স্লোগানই আর এস এসের মূল মন্ত্র৷ তবে এদেশে সে স্বপ্ন সফল হবে না তাদের। কারণ, হাজার হাজার বছরের মিশ্র সংস্কৃতি আর মিশ্র ভাষাভাষীর ভারতবর্ষে কোনো মনগড়া একটি সংস্কৃতির একাধিপত্য কায়েমের চেষ্টা দুঃস্বপ্ন ছাড়া কিছু নয়।
কিন্তু… আমার কথা সেসব নয়। গোমুত্র, গোময় নিয়ে আলোচনা করছিলেন বেশ তো, করুন না। হঠাৎ এসব ভাষা, সংস্কৃতি.. এসবে হাত দিতে যে কেন যাচ্ছেন এরা কে জানে!!!
আরে মশাই, ভক্তকুল! নাগপুরের সিলেবাস পড়লে কেবল চলবে??
রিভলভার মানে কেবল ছ’টা গুলি আর ঠাঁই ঠাঁই ঠাঁই ঠাঁই ঠাঁই ঠাঁই.. নয়; অনেক নিক আছে, ট্রিগার আছে, হ্যামার আছে, অনেকরকম বোর আছে, অনেক ক্যালিভার আছে…এগুলোতো জানতে হবে…..নইলে সবটাই যে উটের কুঁজে জল হয়ে যাবে…
#অশোকভট্টাচার্যরাজা