অন্যান্য 

তৃণমূল কংগ্রেস নামক দলটির সবথেকে বড়ো অবদান হলো , আপোষ-সমঝোতায় হিন্দুত্বের তত্ত্ব , রাজনৈতিকভাবে হিন্দুত্ববাদী শক্তিকে চাষাবাদের সুন্দর ব্যবস্থা করে দিয়েছে ; আর এস এস – বিজেপি –তৃণমূল তো বিভাজনের রাজনীতির এক অসামান্য কারিগর! : ড. আবদুস সাত্তার

শেয়ার করুন
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  

দেশজুড়ে বিজেপি-আরএসএসের তথাকথিত দেশভক্তদের উল্লাসে ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শে বিশ্বাসী মানুষরা দিশেহারা । দেশের আর্থিক অবস্থা শোচনীয় । কিন্ত সেদিকে সরকারের নজর নেই বরং বিভাজনের রাজনীতির দিকেই বেশি মনোনিবেশ করেছেন বেশি মোদী-অমিত শাহরা । ৩৭০ ধারা রদ , তিন তালাকের ফৌজদারীকরণ ও সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন চালু করে মেরুকরণ করতে চাইছে আরএসএস পরিচালিত মোদী সরকার । ভারতকে হিন্দু রাস্ট্রের দিকে নিয়ে যাচ্ছে । এই অবস্থায় ভারতের মানুষই ঘুরে দাঁড়িয়েছে । স্বাধীনতা আন্দোলনের কায়দায় দেশজুড়ে চলছে বিক্ষোভ-আন্দোলন । ইতিমধ্যে মহারাস্ট্র , হরিয়ানা গেরুয়া বাহিনীকে সংকেত দিয়েছিল , কিন্ত তারা তা শোনেনি । এবার স্পষ্ট জনাদেশ দিল ঝাড়খন্ড । প্রমাণ হল ধর্ম নয় , রুটি-রুজির লড়াই শেষ কথা বলে ।কিন্ত তা সত্ত্বে বলা যাবে না গেরুয়াপন্থীদের দাপট কমে গেছে , বরং বলা যেতে পারে তারা হোঁচট খেয়েছে মাত্র । তাদের আদর্শ ও নীতি এখনও জারি রয়েছে । কীভাবে এল হিন্দুত্বের শ্লোগান নিয়ে দেশের রাজনীতিতে আরএসএসের দাপট ? এর নেপথ্যে কোন কোন রাজনৈতিক দল গোপনে বা প্রকাশ্যে বিজেপিকে মদত দিয়েছে । আরএসএস-বিজেপির শিকড় কীভাবে ধর্মনিরপেক্ষ ভারতবর্ষে প্রবেশ করল তা নিয়ে কলম ধরেছেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ , রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী ও প্রদেশ কংগ্রেসের সাধারন সম্পাদক ড. আবদুস সাত্তার । বাংলার জনরব নিউজ পোর্টালে তা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে । আজ চর্তুদশ কিস্তি ।

প্রকাশিত অংশের পর …

Advertisement

এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে , আধুনিক ভারত রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান স্থপতি , প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু’র মৃত্যুর পর ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্নে আপোষ-সমঝোতা বার বার লক্ষণীয় হয়ে উঠেছে । পরিবর্তে ইন্দিরা গান্ধীর জারি করা জরুরি অবস্থার বিপদ বড়ো হয়ে ভারতের রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চে হাজির হয়েছে ।লঘু হয়েছে সাম্প্রদায়িকতার সর্বগ্রাসী বিপদ । আবার এ-ও সত্য যে , ‘৭১-এর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বাধীন সরকারের যে অনন্য সাধারন অবদান , তা স্মরণ করে অটলবিহারী বাজপেয়ী ‘লৌহমানবী’ প্রিয়দর্শিনীকে ‘দেবী দূর্গা’রূপে সম্বোধন করেছেন । প্রসঙ্গত , বামপন্থীদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে পশ্চিমবঙ্গের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীকেও একদা রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ ( আরএসএস) তাদের মুখপত্র ‘অর্গানাইজার’ পত্রিকায় ‘দেবী দূর্গা’রূপে দেশবাসীর সামনে চিত্রিত করেছিল । সম্বোধনের উত্তরে ইন্দিরা গান্ধী নীরব (?) থাকলেও মমতা  বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন সরব । প্রত্যুত্তরে আরএসএসকে ‘দেশপ্রেমিক’ অভিধায় অভিনন্দিত করেছিলেন । স্বভাবতই , এই ধরনের দেশভক্ত , দেশপ্রেমিককে সাহায্য, সহায়তা ছাড়া বাংলা থেকে মার্কসবাদীদের উৎখাত করবেন কি করে ? তাই তো বাজপেয়ী মন্ত্রিসভায় যোগদান , মোদীভাইকে পুস্তস্তবক উপহার । গোধরা কান্ড , দাঙ্গার পর দাঙ্গার ইতিবৃত্ত কি স্মৃতির মুকুরে হারিয়ে যেতে থাকে ? বাংলার রাজনীতিতেও বৈধতা পেতে থাকে সংকীর্ণ , মনুবাদী হিন্দুত্বের রাজনীতি । যার পরিনতিতে ২০১৯ সালের লোকসভার নির্বাচনে বিজেপি রাজ্যে ১৮টি লোকসভার আসন জিততে সমর্থ হয় ।  স্বাধীনতা- উত্তর বাংলার রাজনীতিতে এই প্রথম বিজেপি রাজ্যে লোকসভার প্রায় অর্ধেক আসন জিতে নিতে সমর্থ হলো। তৃণমূল কংগ্রেসের আশ্রয় ও প্রশয় ছাড়া বিজেপি কখনোই , কোনোভাবেই এই রাজ্যে তার প্রভাব বিস্তার করতে পারতো না । পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে তৃণমূল কংগ্রেস নামক দলটির সবথেকে বড়ো অবদান হলো , আপোষ-সমঝোতায় হিন্দুত্বের তত্ত্ব , রাজনৈতিকভাবে হিন্দুত্ববাদী শক্তিকে চাষাবাদের সুন্দর ব্যবস্থা করে দিয়েছে । তাই তো প্রত্যহ বাঙালিকে শুনতে হয় ‘অর্জুনের তিরে পারমানবিক শক্তি’ কিংবা ‘গরুর দুধে সোনা আছে’ / ‘ক্ষমতায় এলে শুয়োরের মতো গুলি করে মারব’ ‘ বাংলা দেশদ্রোহীদের আখড়া’ ইত্যাদি নানা ধরনের বচন !

আর এস এস – বিজেপি –তৃণমূল তো বিভাজনের রাজনীতির এক অসামান্য কারিগর! এই লক্ষ্যে প্রতিনিয়ত ইতিহাসের বিকৃতি ঘটে চলেছে ।জোর কদমে চলছে জাত-ধর্ম-বর্ণের  নামে মানুষের ঐক্যকে চেনা-অচেনা ছকে বিভাজনের রাজনীতিতে রূপান্তরিত করে প্রকাশ্যে হুঙ্কার , রণধ্বনি যা আজকের বাংলার রাজনীতির সব থেকে বড়ো উপাদান হিসাবে জনমানসে হাজির হয়েছে । রাজনীতির বিভাজন , বিভাজনের রাজনীতি প্রায় সমার্থক হয়ে উঠেছে । এই সবেরই ফলশ্রুতিতে আজকের পশ্চিমবঙ্গে শুরু হয়েছে  প্রতিক্রিয়ার শক্তির বিরুদ্ধে প্রগতির আন্দোলন । সাম্প্রতিক সময়ে যে আন্দোলনের ভাবনা ভাষ্য প্রতিনিয়িত রচনা করে চলেছেন ছাত্র-যুব-সাধারন মানুষ । উজ্জ্বল জ্যোতিস্ক রূপে পথ চেনাচ্ছেন সাধারন বাড়ির গৃহবধূরাও । ১৯৬৭-এর পরে ‘গো-বলয়’ হিসাবে চিহ্নিত রাজ্যগুলিতে আএসএস-জনসঙ্ঘ-বিজেপি নিজেদের শাখা-প্রশাখা নিয়ে শক্তি বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছিল । আশ্চর্যের বিষয় হলো , একুশ শতকীয় জ্ঞান-বিজ্ঞান , তথ্য-প্রযুক্তির বিস্ফোরণের যুগে সংকীর্ণ , মনুবাদী তথাকথিত রাজনৈতিক হিন্দুত্বের তত্ত্ব ও দর্শনকে আশ্রয় করে পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে তারা তাদের প্রভুত্ব জাহির করতে সক্ষম হয়েছে । সৌজন্যে অবশ্যই তৃণমূল কংগ্রেসে! শুধু তৃণমূল কংগ্রেসই নয় দেশের নানা রাজ্যে গড়ে ওঠা শক্তিশালী , আঞ্চলিক দলগুলি ক্ষমতার তন্ত্রে নিজেদের ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শকে জলাজ্ঞলি দিয়ে এই শক্তিকে বহুগুণ শক্তিশালী করেছে  ।এও অনস্বীকার্য যে , বিষবৃক্ষের ফল তো আজ  আমাদের সকলের সামনেই রয়েছে ।

উপরে উল্লেখিত এই সমস্ত কিছুর সম্মিলনের ‘বিষময় ফল’ হলো আজকের প্রধান সেবক সেবকের নির্মীয়মান ভারত । সংবিধান ও সংবিধান বহির্ভূত সব পথে, সমস্ত স্তরেই এই শক্তির দাপাদাপি ! শত শত সংগঠন প্রধান সেবক-সেবকগণের তাত্বিক গুরু গোলওয়ালকার কথিত ‘কুচকাওয়াজ’ করে ‘হিন্দুরাষ্ট্র’ নির্মাণের লক্ষ্যে এগিয়ে চলেছে । বহুত্ববাদী , ধর্মনিরপেক্ষ , উদার মনোভাবাপন্ন ,মানুষের অধিকার সংগ্রাম-লড়াইয়ে বিশ্বাসী ভারতীয় মুল ধারার বিশিষ্ট রাজনৈতিক দলগুলিকে আজ তার মূল্য দিতে হচ্ছে । সাম্প্রদায়িকতা-জাত অসহিষ্ণু হিন্দুত্বের উগ্র জাতীয়তাবাদী শক্তিকে নানা অঙ্কে হিসাব করে তোষণ , সহযোগিতার কঠোর , কঠিন মূল্যে শুধুমাত্র কংগ্রেস সহ জাতীয় স্তরে মূল ধারার রাজনৈতিক  দলগুলিকেই নয়, দেশের অসহায়,গরিব প্রান্তিক মুসলিম ও দলিত সম্প্রদায়ের মানুষদেরও জান-মাল ধনের বিনিময়ে প্রত্যক্ষ করতে হচ্ছে না ? ক্রিয়ার তুলনায় প্রতিক্রিয়ার শক্তি আজ বহুগুণে বিবর্ধিত । প্রচারযন্ত্রের শক্তিশালী আলোর রেখায় আজ তার বহুরূপী রূপ বোকা-বাক্স-সামাজিক মাধ্যমের কল্যাণে মানুষের ঘরে ঘরে । অস্থি-মজ্জা অতিক্রম করে এখন তো মানুষের ‘নাভিমূলে’ প্রবেশ করতে সক্ষম হয়েছে । তথাকথিত রাজনৈতিক হিন্দুত্বের সংকীর্ণ কানাগলিতে দেশের বৃহত্তর অংশের মানুষকে ঠেলে দিতে সমর্থ হয়েছে । সংবিধান প্রদত্ত নাগরিকের মৌলিক অধিকার –এর  রাজনীতিকে এই প্রতিক্রিয়ার শক্তি দেশ-বিদেশের সামনে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অসহায়ের আর্তনাদ হিসাবে চিহ্নিত করে চলেছে । ভূবনীকরণ , নয়া উদারীকরনে বাজারী মন্ত্রে সজ্জিত হয়ে ‘হিন্দি, হিন্দু,হিন্দুত্বে’র ভিত্তিতে গড়ে ওঠা সঙ্খবদ্ধ সাম্প্রদায়িক পরিবারের শক্তির হুমকির কপাঙ্ক দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় ও প্রশাসনিক পরিমন্ডলকে ভেঙেচুরে নিজেদের মতাদর্শের রঙে রাঙিয়ে  নেওয়ার খেলায় প্রমত্ত।

দেরি হয়েছে তবু প্রতিক্রিয়ার এই শক্তির বিরুদ্ধে প্রগতির লড়াই আন্দোলন-সংগ্রাম আজ পথে পথে । পথ বেঁধে দিয়েছে বন্ধনহীন গ্রন্থি । বন্ধনহীন এই গ্রন্থি হিন্দু-মুসলিমের পরিচিত বিভাজনের রাজনীতিকে সরিয়ে দেশব্যাপী মানুষের ঐক্যকে সুদূরপ্রসারী করে চলেছে । ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে এ আমাদের ঋণ । দায় , দায়িত্বও । এই লড়াইয়ে অসংখ্য শহীদ । তবু মানুষ , মানুষের ধর্ম, মানবতাবাদের লক্ষ্যে গগণভেদী আওয়াজ : ‘মানুষের মৃত্যু হলে / তবু মানব থেকে যায়’। ( সমাপ্ত)


শেয়ার করুন
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  

সম্পর্কিত নিবন্ধ

Leave a Comment

ten + four =