অন্যান্য 

ভোট আসে , ভোট যায় , প্রতিশ্রুতির বন্যা বয় , সংখ্যালঘুরা যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই থেকে যায় !

শেয়ার করুন
  • 2
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  

সেখ ইবাদুল ইসলাম : সপ্তদশ লোকসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে । স্বাধীনতার পর থেকে ১৬তম লোকসভা গঠিত হয়েছে । দেশের আইন-সংবিধান রক্ষায় লোকসভার ভূমিকাকে অস্বীকার যাবে না। গনতন্ত্রে নির্বাচন ব্যবস্থা আধুনিক এবং উন্নত ব্যবস্থা বলে পরিচিত । সময়ের বিচারে আমাদের দেশ স্বাধীন হয়েছে ৭২ বছর । এই বাহাত্তর বছরে কেউ কথা রাখেনি । ইতিহাস বলছে ,দেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে বড় বড় রাজনৈতিক দলগুলির প্রতিশ্রুতি ছিল সংখ্যালঘুদের উন্নয়নে তারা কাজ করবে । তাদের জান-মালের নিরাপত্তা দেবে । ৭২ বছর পর হিসাব মেলাতে বসলে দেখতে পাবেন , সপ্তদশ লোকসভা নির্বাচনেও দেশের প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলি সংখ্যালঘুদের একই প্রতিশ্রুতি দিয়ে চলেছে ।

তবে মনে রাখতে হবে আমাদের দেশে সংখ্যালঘূ সম্প্রদায় বলতে ৬টি গোষ্ঠীকে বোঝায় । মুসলিম , খ্রিষ্টান ,পারসি , জৈন , বৌদ্ধ ও শিখ । এদের মধ্যে ৫ টি সম্প্রদায়কে ভোটের বোড়ে করা সম্ভব হয় না রাজনৈতিক দলগুলির । কারণ তাদের অধিকাংশই শিক্ষিত এবং সমাজ মনস্ক । ফলে তাদেরকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করা সম্ভব হয় না । শুধুমাত্র মুসলিম সম্প্রদায়কে স্বাধীনতার পর থেকে রাজনৈতিক দলগুলি ব্যবহার করে আসছে । কারণ অবশ্য আছে তা হল দেশভাগের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা পাওয়া । ধর্মের ভিত্তি দেশভাগ হওয়ার কারণেই এই দেশের মুসলিমরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে থাকে । আর একে সুযোগ হিসাবে ব্যবহার করে চলেছে রাজনৈতিক দলগুলি । শুধুমাত্র নিরাপত্তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোট হাসিল করেছে দেশের তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দলগুলি । তাই খুব সহজেই ভোটের বোড়ে হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে এদেশের সংখ্যালঘুরা ।

Advertisement

দেশের কথা না হয় বাদই দিলাম খোদ আমাদের পশ্চিমবাংলা যাকে সম্প্রীতির অনন্য রাজ্য বলা হয়ে থাকে । সেখানে সংখ্যালঘুরা সংবিধানে প্রদত্ত অধিকার পেয়েছে ? অথচ এই রাজ্যে স্বাধীনতার পর থেকে ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলি ক্ষমতায় আছে । তারা কী দিয়েছে রাজ্যের সংখ্যালঘু মুসলিমদের । এক নজরে দেখে নেওয়া যাক :

১৯৪৭-৬৭ একটানা কংগ্রেস সরকার ক্ষমতায় ছিল । বিশ বছরে এই রাজ্যের সংখ্যালঘুরা শুধুই উপেক্ষার শিকার হয়েছিল । ৬৪-র ভয়াবহ দাঙ্গায় কলকাতার বিস্তীর্ণ অঞ্চল থেকে মুসলিমরা বিতাড়িত হয়েছিল । ইতিহাস বলছে সেদিনের দাঙ্গার নেপথ্যে শাসক কংগ্রেস দলের ভূমিকা অস্বীকার করা যাবে না । এমনকি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গুলজারিলাল নন্দাকে কলকাতায় ছুটে আসতে হয়েছিল দাঙ্গা বন্ধ করার জন্য । সেই ভয়াবহ দাঙ্গায় এই রাজ্যের সংখ্যালঘুদের মনে যে আতংক সৃষ্টি হয়েছিল তা ৫০ বছর পরেও সেই আতংক থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি তারা ।

১৯৬৭-৭১ দাঙ্গার ভয়াবহ স্মৃতিকে  উসকে  দিয়ে কংগ্রেস দলেই ভাঙন দেখা দিয়েছিল । তৈরি হয়েছিল বাংলা কংগ্রেস । এই বাংলা কংগ্রেসকেই আঁকড়ে ধরেছিল এই রাজ্যে সংখ্যালঘু মুসলিমরা । ৬৭ সালে ক্ষমতায় আসে যুক্তফ্রন্ট সরকার , সেই সরকার দু বছর অতিবাহিত করার পরেই ভেঙে যায় । আবার ক্ষমতায় আসে যুক্তফ্রন্ট সরকার । এবার এই সরকারে সামিল হয় মুসলিম লীগ । সেই সময় মুসলিম লীগ বিধানসভায় ভাল আসন পেয়েছিল ।

১৯৭২ সালে সারা দেশজুড়ে কংগ্রেস হাওয়ায় ভর করে এই রাজ্যে ক্ষমতায় আসে কংগ্রেস দল । সিদ্ধার্থ শংকর রায়ের নেতৃত্বে গঠিত হয় কংগ্রেস মন্ত্রীসভা । এই মন্ত্রীসভায় গুরুত্বপূর্ণ দফতরের কয়েকটিতে মুসলিম বিধায়কদের মন্ত্রী করা হয় । ফলে কিছুটা হলেও পাপের প্রায়শ্চিত্ত করেন সিদ্ধার্থশংকর রায় । তিনি এরাজ্যের সরকারি চাকরিতে মুসলিম প্রতিনিধিত্বের হার অনেকটাই দিয়েছিলেন । শুধুমাত্র পুলিশেই ৯ শতাংশ চাকরি পেয়েছিল মুসলিমরা ।

কিন্ত ৬৪ দাঙ্গার ভয়াবহতা তখনও মুসলিমদের মন থেকে মুছে যায়নি । আর অনেক আগে থেকেই নির্দল সাংসদ সৈয়দ বদরুদ্দোজা ও বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ হুমায়ুন কবীরের মত মানুষরা কংগ্রেসের বিরুদ্ধে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছিলেন । মূলত তাঁদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টাতেই রাজ্যের সংখ্যালঘুদের একটা বড় অংশ ঝুঁকে পড়েছিল বামপন্থীদের দিকে । সেই ঝুঁকে পড়া সংখ্যালঘু সমাজের প্রচারের ফলে সিদ্ধার্থশংকর রায়ের মন্ত্রীসভা ভাল কাজ করা সত্ত্বে কংগ্রেসকে সমর্থন দেয়নি রাজ্যের সংখ্যালঘুরা । তারা বামেদের প্রতি আস্থা দেখিয়েছিল ।

ফলে ১৯৭৭ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বিপুল গরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসে বামেরা । ১৯৭৭-২০১১ দীর্ঘ ৩৪ বছরে বামেদের ভূমি –সংস্কার কর্মসূচিতে রাজ্যের গ্রামীণ অর্থনীতির বিকাশ ঘটলেও এরাজ্যের সংখ্যালঘূদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন সেভাবে হয়নি । দাঙ্গার ভয় দেখিয়ে , বিজেপির জুজু দেখিয়ে , আর নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে দশকের পর দশক ধরে ক্ষমতায় থেকেছে বামেরা ।

আর রাজ্যের মুসলিমরা যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই থেকে যায় । তাদের কোনো উন্নয়ন বামেরা করে উঠতে পারেনি । বাম আমলে সংখ্যালঘু সমাজ যেটুকু উন্নয়ন করতে পেরেছে তার নেপথ্যে সরকারের কোনো ভূমিকা ছিল না , বরং সংখ্যালঘু সমাজ নিজেদের তাগিদ থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ছিল । রাজ্যের সংখ্যালঘু ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনা করার জন্য বিশেষ আর্থিক সাহায্য সরকার করেনি । ২০০৬ সালের সাচার রিপোর্ট প্রকাশ হওয়ার পরেই এই সত্য সবার কাছে উন্মোচিত হয়ে পড়ে । ধর্মনিরপেক্ষতার রক্ষক বলে দাবি করা সিপিএম নেতারা মুখ লুকোতে থাকেন ।

অথচ স্বীকার করতেই হবে বামেদের ক্ষমতায় টিকে থাকার নেপথ্যে ছিল রাজ্যের মুসলিমদের অবদান সবচেয়ে বেশি । তাদের রক্তের বিনিময়ে বামপন্থীরা এ রাজ্যে ৩৪ বছর ক্ষমতায় টিকে ছিল । খাদ্য আন্দোলনে শহীদ নুরুল ইসলাম লাশ দেখিয়ে বামপন্থীরা সমগ্র রাজ্যজুড়ে আন্দোলনের ঢেউ তুলেছিল ক্ষমতায় আসার পর নুরুলের মাকেই ভুলে গিয়েছিলেন জ্যোতিবাবুরা ।  সৈয়দ বদরুদ্দোজাকে কাজে লাগিয়ে মুসলিম সমাজে বামপন্থীদের গ্রহণযোগ্য করে তুলেছিল  , সেই বদরুদ্দোজাকে ইন্দিরা গান্ধী জেলে পাঠালে তার বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ করতে দেখা যায়নি বামেদের । আসলে এরাজ্যের বামেরা সব সময় রাজনীতিতে অকৃতঞ্জতার পরিচয় দিয়েছে । এরা ভুলে যায় বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ হুমায়ুন কবীরকেও ।

২০১১ ক্ষমতায় এল তৃণমূল কংগ্রেস । সেদিন এই প্রতিবেদক সংবাদপত্রে শিরোনাম করেছিল বাংলা আবার স্বাধীন হল । মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সামনে রেখে বাংলার শুধু মুসলিমরা নন , সমগ্র রাজ্যবাসী প্রত্যাশা করেছিল এমন এক সরকার তিনি উপহার দেবেন যারা সত্যিকার অর্থে মা-মাটি-মানুষের জন্য কাজ করবে । কিন্ত বাস্তব সত্য হল , মমতার সরকার মা-মাটি-মানুষের সরকার নয় , এটা হল মানির সরকার । তোলাবাজির সরকার ।

আর সংখ্যালঘু উন্নয়ন ! তা আর না বলায় ভাল । অথচ নন্দীগ্রামের সংখ্যালঘুরা সেদিন যদি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পাশে না দাঁড়াতেন তাহলে হয়তো আজকে তাঁকে মুখ্যমন্ত্রী পদে দেখা যেত না । বামফ্রন্ট সরকার সিঙ্গুরে জমি আন্দোলনকে উপেক্ষা করেই টাটাদের জমি দিয়েছিল এবং তারা সেখানে কারখানা করে ফেলে । শুধুমাত্র গাড়ি বের করার অপেক্ষায় ছিল । ঠিক সেই সময় ঘটে যায় নন্দীগ্রামের জমি আন্দোলন । আর এই জমি আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন নন্দীগ্রামের আ্বদুস সামাদ । এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে মমতা ঝাঁপিয়ে পড়েন নন্দীগ্রামে । আর নন্দীগ্রামের মানুষ তখন সিপিএমের হার্মাদদের হাত থেকে বাঁচার জন্য এই রকম একজন নেত্রীকে খুঁজছিলেন । নন্দীগ্রাম আন্দোলন সফল হওয়ার পরেই আবার নতুন করে সিঙ্গুর কারখানার কাছে ধর্ণায় বসে যান মমতা ।

যাইহোক মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতায় আসার আগে যা যা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তা কী পূরণ করেছেন ? তিনি তো রিজওয়ানুরের মাকে ইনসাফ পাইয়ে দেবেন বলেছিলেন ? সেই রিজওয়ানুরের মা ইনসাফ পেয়েছেন ? নাকি রিজওয়ানুরের মৃত্যুর জন্য দায়ী পুলিশ অফিসারদের ভালো ভালো পদে পোষ্টিং দেওয়া হয়েছে যাতে তার পাটির স্বার্থে  কাজ করে । তার প্রমাণ মিলেছে নির্বাচন কমিশনের এক সিদ্ধান্তে । বিধাননগরের পুলিশ কমিশনার  জ্ঞানবন্ত সিং-র বিরুদ্ধে ছিল গুরুতর অভিযোগ তা সত্ত্বে তাকে কমিশনার পদে বসিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় । আর  এক সময়কার তাঁর ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত এবং সৎ অফিসার বলে রাজ্য  তথা দেশে পরিচিত ছিলেন আইপিএস নজরুল ইসলাম । তাঁর প্রতি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আচরণ প্রমান করেছে তিনি কতখানি স্বৈরাচারী শাসক ।

প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন দশহাজার আন-এডেড মাদ্রাসা দেব । দিয়েছেন ? না মাত্র ২৩৪টি । তাও আবার তাদেরকে কেন্দ্রীয় সরকারের সাহায্য থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে । মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সংখ্যালঘুদের প্রতিশ্রুতি দিয়ে কী কী পালন করেননি তার বিস্তারিত বিবরণ আগামী দিনে দেওয়া হবে ।


শেয়ার করুন
  • 2
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  

সম্পর্কিত নিবন্ধ

Leave a Comment

three × one =